৮ মাসের সন্তানের কাছে ফেরা হলো না নুর নাহারের

সড়কে প্রাণ গেল ছয়জনের

দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সিএনজি
দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সিএনজি | ছবি: এখন টিভি
0

আট মাসের দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে রেখে গৃহবধূ নুর নাহার (৪০) এসেছিলেন রাণীরহাট বাজারে। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি তার। মাঝপথেই ঘাতক পিকআপ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার। শুধু তিনিই নন প্রাণ ঝড়েছে আরও পাঁচজনের। আর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ওই সিএনজি অটোরিকশার পা-দানীতে ছোপ ছোপ রক্তে লেপ্টে আছে শাক, তিতা করল্লা আর মিষ্টি কুমড়া। কেবল বোঝার উপায় নেই কোনটা নুর নাহারের। অদূরেই পুলিশ ফাঁড়ির মাঠে শায়িত নুর নাহার, আবু তোবাব-(৫০) ও মাহবুবুর রহমান বাচ্চুর (৫০) রক্তমাখা নিথর দেহ।

আর তাদের সাথে সংখ্যায় যুক্ত হয়েছেন হাসপাতালে মারা যাওয়া মিনু মারমা (৩৫), জয়নাল আবেদীন(৬০), ও সিএনজি চালক ইজাজুল(২৫)।

মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে আজ (শনিবার, ২৬ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় রাঙামাটি- চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া চেয়ারম্যান পাড়া এলাকায়।

রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের রাণীরহাট বাজার থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রাম থ-১১-৯১৭৩ নম্বরের যাত্রীবাহী অটোরিকশাকে মুখোমুখি চাপা দেয় বিপরীত দিক থেকে আসা চিড়াই কাঠবোঝাই চট্টমেট্রো ন-১১-৬৪৯২ নম্বরের পিকআপ। এতে মুহূর্তেই দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সিএনজির তিন যাত্রী দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তাৎক্ষণিকভাবে পথচারী ও স্থানীয়রা সিএনজির চালক ও আহত দুই যাত্রীসহ তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। এসময় ঘটনাস্থলে নিহত তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে কাউখালীর বেতবুনিয়া ফাঁড়িতে নিয়ে যায় পুলিশ। তবে দুর্ঘটনার পরপরই পিকআপ চালক ও সহকারী পালিয়ে যায়। পরে দুর্ঘটনার শিকার সিএনজি অটোরিকশা ও পিকআপটি উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয়া বেতবুনিয়া ফাঁড়ির পুলিশ।

নিহতদের মধ্যে নুর নাহার কাউখালী উপজেলার পশ্চিম মনাইটেক ও মিনু মারমা কাউখালীর বেতবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা। এছাড়া আবু তোরাব চট্টগ্রামের রাউজান চৌধুরী পাড়া, মাহমুদুর রহমান বাচ্চু চট্টগ্রাম হাটহাজারীর ছাত্তারঘাট, মো. জয়নাল আবেদীন চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর ও সিএনজি চালক ইজাজুল চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকার বাসিন্দা।

আজ দুপুরে বেতবুনিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ঘিরে স্বজন আর উৎসুক জনতার ভিড়। মানুষের ঢল সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকেও। এদের মধ্যে কেউ কেউ দুষছেন সড়কের বাঁককে, কেউ বা চালকের অদক্ষতাকে। তবে দুর্ঘটনা বন্ধে সড়কটির বাঁককে সোজা ও প্রশস্ত করার দাবি জানিয়েছেন বাসিন্দারা।

নুর নাহারে মোবাইল ফোনে নুর নাহারের মৃত্যুর খবর পেয়ে বেতবুনিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে ছুটে এসেছেন তার স্বামী আব্দুর রহিম (৪৫)। তিনি বলেন, 'সকালে আমি কাজে গিয়েছি। আমার স্ত্রী রাণীরহাট বাজারে এসেছিল। সিএনজি করে বাজার নিয়ে ফিরছিল। সাড়ে ১০টার দিকে তার ফোন থেকে কেউ একজন জানায় তার মৃত্যুর খবর। আমার আটমাসের দুধের বাচ্চার এখন কী হবে? আমার সংসারের কী হবে? আমার তিন সন্তানকে কে দেখবে? কার কাছে বিচার চাইবো। আল্লাহ আমাকে এ কোন বিপদে ফেললো?'

নিহত নুর নাহারের ভগ্নিপতি স্থানীয় বাসিন্দা মো. বেলাল বলেন, 'নুর নাহারের পরিবার গরীব। মামলা মোকদ্দমা করে পারবে না। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।'

স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সড়কটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সরু। গেল ১৬ এপ্রিল ভোরে ঢাকা থে‌কে রাঙামাটিগামী রবি এক্সপ্রেসের সেন্টমার্টিন হুন্দাই এসি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে। এই ঘটনায় চালকসহ পাঁচজন যাত্রী আহত হন। আজ আবার ছয়জনের মৃত্যু হলো। সড়কটির বাঁক সোজা ও প্রশস্ত করা খুবই জরুরি। নইলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে থাকবে।'

আজ ঘটনাস্থল ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কিছুটা ঢালু দুর্ঘটনা স্থলটিতে মূলত একাধিক বাঁক রয়েছে। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি আগ থেকেই দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে দ্রুতগতিতে চালাতে গিয়ে যানবাহন মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আবার মূল সড়ক থেকে ছিটকে সড়কের প্রান্তের নালায় ও খাদে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানটিতে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধে বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

কাউখালী থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম সোহাগ বলেন, 'ঘটনাস্থলেই সিএনজির তিন যাত্রী নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে নেয়া হলে সিএনজি চালকসহ আরও তিন জন মারা গেছেন। সবমিলিয়ে ওই দুর্ঘটনায় সিএনজির চালক ও যাত্রীসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাঙামাটির মর্গে নিয়েছে। আইনি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। দুর্ঘটনায় ক্ষতির শিকার কারও পক্ষ থেকে এখনও কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পাওয়া না গেলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে।'

রাঙামাটি জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'দুর্ঘটনার পর আমরা আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। পিকআপ চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করা হবে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যেই হোক তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সড়কটিতে যানবাহনের চাপ বেশি। রাঙামাটিতে পর্যটক ছাড়াও বিপুল পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আমরা বিবেচনায় রাখছি।'

এসএস