উত্তর আমেরিকা
বিদেশে এখন
0

যে কেলেঙ্কারিতে ক্ষমতা ছাড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন

ইতিহাসের একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। কিন্তু কী কারণে তাকে এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে হয়? এই প্রতিবেদনে সেই তথ্যই আজ জানা যাবে।

১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট দুপুর ২টা নাগাদ খবর আসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। গুঞ্জন ওঠে ক্ষমতার আসন থেকে সরে আসছেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরোবিশ্ববাসীর কান তখন রেডিওতে। আসলেই ক্ষমতা ছাড়ছেন নাকি অন্য কিছু, এসব নিয়ে চলছে উত্তেজনা। ঠিক রাত আটটায়, সরকারি দপ্তর থেকে জাতির সামনে হাজির হন রিচার্ড নিক্সন। ভাষণে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ারই ঘোষণা দিলেন তিনি। তার এই পদত্যাগের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে নিক্সন যুগের।

এরই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। কারণ অনেকটা বাধ্য হয়েই পদত্যাগ করতে হয়েছিল নিক্সনকে। এর আগে বা এখন পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্টকেই এমন বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়নি।

নিক্সনের এই পদত্যাগের পেছনে ছিল মার্কিন রাজনীতির সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়েই পদ থেকে বিদায় নেন রিচার্ড নিক্সন।

এই কেলেঙ্কারির শুরুটা হয় ১৯৭২ সালের জুন মাসে। যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হাওয়া বইছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে।

এই সময় ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট হোটেলের ডেমোক্রেটিক পার্টির সদর দপ্তর থেকে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে। সাথে জব্দ করা হয় একটি আড়িপাতার যন্ত্র এবং দুই হাজার তিনশ' ডলার।

সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিপাবলিকান সদস্য রিচার্ড নিক্সন। রিপাবলিকান প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের লড়াইয়েও নেমেছিলেন তিনি।

এর আগে ১৯৬৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা নেয়ার পর বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা বা চীনা নেতাদের সাথে সখ্যতা যাই হোক না কেন সবমিলিয়ে নিক্সন তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

কিন্তু ১৭৭২ সালের ১৬ জুন পরিস্থিতি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যায়। ওয়াটারগেট হোটেলের ছয়তলায় ডেমোক্রেটিক পার্টির সদর দপ্তর, যেখান থেকে নির্বাচন সংক্রান্ত সবকিছু পরিচালনা করা হতো। এই কার্যালয় থেকেই আড়িপাতার যন্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে। যাদের উদ্দেশ্য ছিল এখানে কী কথাবার্তা হয় তা নজরদারিতে রাখা। সেখানের টেলিফোন সেটে মাইক্রোফোন লাগানো শুরু করেন ওই পাঁচজন, সাথে গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবিও তুলতে থাকেন। এমন অবস্থায় গার্ডের হাতে ধরা পড়েন তারা। এসময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় দুই হাজার তিনশ' ডলার।

এরপর শুরু হয় তদন্ত। ওই পাঁচ অনুপ্রবেশকারীর তদন্ত তো শুরু হয়ই সেই সাথে শুরু হয় ডলারের নোটের সিরিয়াল নাম্বার নিয়েও খোঁজ খবর।

এদিকে ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক একটি বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। যেখানে ডিপ থ্রোট ছদ্মনামে গোপন এক সূত্রে বরাতে তারা জানান এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন জড়িত।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তখন উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রশ্নবানে জর্জরিত নিক্সন এক কথায় অনড় থাকেন। জানান, এসব অপপ্রচার, বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র। নির্বাচনকে সামনে রেখেই নাকি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির এই উত্তেজনার মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না নিক্সনের জনপ্রিয়তার কাছে। বিপুল ভোটে জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নিলেন। শপথ নিলেন দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি হয়ে।

কিন্তু অন্যদিকে সেই দুই সাংবাদিক যেন দমে যাবেন না বলেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ভেতরে ভেতরে তারা তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখছিল।

তাদের প্রতিবেদনে বেরিয়ে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই ৫ অনুপ্রবেশকারী মোট চারবার ঢুকেছিল ডেমোক্রেট পার্টির কার্যালয়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হল তাদের নাম-পরিচয়। সামনে আসল এদের একজন ছিলেন নিক্সনের নির্বাচনী প্রচারের নিরাপত্তা কর্মকর্তা। এছাড়াও জব্দ করার নোটের সিরিয়াল নাম্বারের সাথে মিল পাওয়া যায় নিক্সনের নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য রাখা নোটের। সন্দেহের তীর আরও জোরালোভাবে নিক্সনের দিকেই যেতে থাকে। কিন্তু নিক্সনের ওই এক কথা, সবটাই ষড়যন্ত্র।

তদন্তে নেমে পড়লো এফবিআই ও সিআইএ। মার্কিন সিনেটে গঠিত হলো তদন্ত কমিটি। এই কমিটির সরকারি প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পেয়েই কাজে নেমে পড়েন আর্চিবাল কক্স। অনুসন্ধানের প্রথমেই চাইলেন ১৯৭২ সালের পূর্ববর্তী সব ফোনালাপের রেকর্ড।

নিক্সনও পড়ে গেলেন মহাবিপদে। যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন নিক্সন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে শুধু গুরুত্বপূর্ণ ফোনকল রেকর্ড করে সুরক্ষিত করা হলেও নিক্সন ক্ষমতায় বসে সবধরনের ফোনালাপ রেকর্ড করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

নিজেকে বাঁচাতে ফোনালাপের রেকর্ড তো দিলেনই না এবার কক্সকেই বরখাস্ত করে বসলেন তিনি। প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদস্বরুপ তৎকালীন অ্যাটর্নী জেনারেল পদত্যাগ করেন। গণমাধ্যমে একের পর এক শিরোনাম হতে থাকে নিক্সনকে নিয়ে।

বলা হয় মানুষের মস্তিষ্ক যখন অতিরিক্ত চাপে থাকে বা তখন মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। নিক্সনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো, নিজেকে বাঁচানোর তাড়নায়। চাপের মুখে ফোনালাপের রেকর্ড দিলেও নষ্ট হওয়ার অযুহাতে ১৯৭২ সালের ২০ জুনের ১৮ মিনিটের কথোপকথন গায়েব করে দেন।

কথোপকথন ঘেটে তদন্ত কমিটির সদস্যরা নিশ্চিত হন ওয়াটারগেটের ঘটনায় নিক্সনই জড়িত। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুলাই নিক্সনকে অভিসংশন করতে প্রস্তাব দেয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু নিক্সন অভিশংসনের মুখোমুখি হতে চায়নি। নিজের আর অসম্মান চাননি বলে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নেন। মার্কিন ইতিহাসে তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।


এসএস