মা ভারতীয়, বাবা পাকিস্তানি: পরিবার বিচ্ছিন্ন সন্তানের আহাজারি

মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সন্তান | ছবি: সংগৃহীত
0

সিন্ধু নদের পানিবণ্টন বন্ধ জারি থাকলে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তবে পরিস্থিতি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে দিলে তা চরম নির্বুদ্ধিতা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে দুই দেশের সীমান্তে দেখা মিলছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার করুণ চিত্র। উল্টোদিকে সন্ত্রাসী হামলার শিকার ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর ফের মুখর হচ্ছে পর্যটকদের পদচারণায়।

মা ভারতীয়, বাবা পাকিস্তানি। এদিকে ভারতে অবস্থানরত সকল পাকিস্তানির ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরার সময় বেঁধে দিয়েছে নয়াদিল্লি। তাই বাবার সঙ্গে এক কিশোরকে পাকিস্তানে ফিরতে হচ্ছে। মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোববার (২৭ এপ্রিল) পাঞ্জাব সীমান্তে কান্নায় ভেঙে পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত সন্তান।

তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরে হামলা চালিয়েছে যারা, তাদের শাস্তি দিক। আমরা কী পাপ করেছি? আমাকে আমার মায়ের সাথে যেতে দেয়া উচিত। এখানে আমরা এসেছি মায়ের সাথে, তাকে আমাদের সাথে যেতে দিক। তাকে ছাড়া আমরা ফিরতে চাই না।’

ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দেশটি তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী করে পাকিস্তানকে। সপ্তাহ পেরোতে চললেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবশ্য কোনো প্রমাণ সামনে আনতে পারেনি ভারত। কিন্তু এ নিয়ে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানিদের জন্য সব ধরনের ভিসা স্থগিত এবং আগেই ইস্যুকৃত ভিসা বাতিল করে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২৯ এপ্রিলের মধ্যে ভারত ত্যাগের তোড়জোড়ে ব্যস্ত পাঞ্জাবের আত্তারি-ওয়াগাহ সীমান্ত এলাকা। প্রতিবেশি দুইদেশের দ্বন্দ্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে অগনতি পরিবার, কবে আবার দেখা হবে- নেই সে নিশ্চয়তাও।

সেই কিশোরের বাবা বলেন, ‘স্ত্রীকে ছাড়া এখান থেকে ফিরতে আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে। আমার ছেলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আমার সব বাচ্চারা ছোট। সবাই কাঁদছে। সারারাত তারা কেঁদেছে। আমার মন ভেঙে যাচ্ছে তাদের কাঁদতে দেখে। আমার অন্যায়টা কী? মোদি আর শেহবাজ শরীফকে অনুরোধ করছি, এই পরিবারগুলো যেন নিজ নিজ ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য একটা উপায় বের করে দিন।’

অন্যদিকে, হামলার ঠিক পাঁচদিনের মাথায় আবারও পর্যটকদের পা পড়তে শুরু করেছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে। দিনে পাঁচ থেকে সাত হাজার পর্যটকের পদচারণায় মুখর পেহেলগাম এ কয়েকদিন প্রায় জনশূন্য থাকলেও রোববার থেকে সেখানে পৌঁছাতে শুরু করেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা।

পর্যটকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও আর নিরাপদ জায়গা বলে কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে এ ধরনের পরিস্থিতি আমাকে বেড়ানো থেকে, নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হওয়া থেকে আটকাতে পারবে না।’

অন্য একজন বলেন, ‘আমরা পেহেলগামে আছি। পর্যটকদের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। কিন্তু পেহেলগামে বাজার আর সবকিছু খোলা আছে। ভয়ের কিছু নেই।’

ভারতের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল কাশ্মীর উপত্যকায় অর্থনীতির মেরুদণ্ড পর্যটন। হিমালয়ের কোলঘেঁষা অঞ্চলটিতে গেলো বছর ভ্রমণ করেন ৩০ লাখের বেশি পর্যটক। পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জনের সবাই পর্যটক। এ হামলায় দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর, চিরবৈরি দুই প্রতিবেশির সম্পর্কে নতুন করে পারদ চড়ছে।

ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করা থেকে শুরু করে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতসহ দুই দেশই নিয়েছে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা। এসব পদক্ষেপ রাজনৈতিক হুংকার পর্যন্ত সীমিত থাকবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।

ভারতের হরিয়ানার রাজনৈতিক বিশ্লেষক এস.ডি. মুনি বলেন, ‘এটা রাজনীতির প্রশ্ন। ভারত আর পাকিস্তান- দুই দেশের সরকারই চায় নিজ নিজ জনগণের কাছে নিজেদের শক্তিশালী সরকার প্রমাণ করতে। উভয়পক্ষই নিজ নিজ দেশের মানুষকে তাদের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে আমরা খুব শক্ত জবাব দেবো। এটা যুদ্ধের শব্দচয়ন হলেও সত্যি সত্যি যুদ্ধের বিষয়ে তারা সতর্ক। আমি মনে করি যে দুই পক্ষই এটা স্পষ্ট বোঝে যে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে কোনো লাভ বয়ে আনবে না।’

সিন্ধু নদের পানিবণ্টন বন্ধ অব্যাহত থাকলে ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। তবে পরিস্থিতি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে না বলে আশ্বস্ত করছেন।

এস.ডি. মুনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি ফুরিয়ে যেতে পারে। যদি তা সত্যিই হয়, তাহলে পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা আছে। কিন্তু তাও আমি বলবো যে এটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নাও নিতে পারে। আমরা সবাই এটাই আশা করছি এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতিও যুদ্ধের অনুকূলে নেই। তাই যুদ্ধ হবে না। আমি মনে করি যে দুই দেশের এক দেশও যদি বড়সড় যুদ্ধের দিকে এগোয়, তা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা।’

জম্মু-কাশ্মীর ও আজাদ কাশ্মীর নামে কাশ্মীর উপত্যকার দু’টি অংশ আলাদাভাবে শাসন করে ভারত ও পাকিস্তান। চীনসহ তিন দেশের মধ্যে বিভক্ত বিতর্কিত হিমালয়ান অঞ্চলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ।

এসএস