এশিয়া
বিদেশে এখন
0

মিয়ানমারে কোণঠাসা জান্তা বাহিনী

স্বাধীনতার পর ৭ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। তবে এবার দেশটির সামরিক জান্তা সরকারের সংকট নজিরবিহীন। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে তারা।

সামরিক সক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বে ৩৫তম মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ থেকে দুই ধাপ উপরে আছে তারা। এমন একটি শক্তিশালী বাহিনীকে রীতিমতো নাজেহাল করে তুলেছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বেশিরভাগ এলাকায় একের পর এক ঘাঁটি বেদখল ও শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পালাচ্ছে সেনারা। অথচ দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকা মিয়ানমারের সেনাশাসনকে একবিন্দু টলাতে পারেনি আন্তর্জাতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা। দেশটির সংসদের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ।

অস্ত্রে সুসজ্জিত ও সরকারের মদদপুষ্ট হয়েও এখন চরম সংকটে পড়েছে জান্তা বাহিনী। ভেঙে পড়ছে তাদের সামরিক সক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট ফর পিসের তথ্য মতে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা আছে। এদের মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে ৭০ হাজার সেনা। অন্যদিকে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী দলে জাতিগত গোষ্ঠী ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য প্রায় কয়েক লাখ। তাদের সঙ্গে গেরিলা গোষ্ঠীও আছে।

বর্তমান সংকটের শুরু হয় অং সান সুচিকে বিদায় করে জান্তা সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের পর। গত তিন বছরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ২৬ লাখ মানুষ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে সারাদেশে চলে দমন অভিযান। সেইসঙ্গে দেশটিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানি সংকটে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের।

জান্তা বিরোধী বিক্ষোভকারীরা জাতীয় ঐক্য সরকার নাগ গঠনের পর নিজেদের সামরিক শাখা গণপ্রতিরোধবাহিনী বা পিডিএফ গড়ে তোলে। পুরোনো জাতিগত বিদ্রোহীদের বড় একটি অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। মিয়ানমারের প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও শহরে স্থানীয়দের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সামরিক শাখা। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রুপ আছে যারা বিভিন্ন ধরনের দেশি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী। এগুলোর মধ্যে লোহার পাত ও গানপাউডার দিয়ে তৈরি মাইন জান্তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর।

মূলত গত অক্টোবরে দেশটির উত্তরাঞ্চলে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিন বাহিনীর সুসজ্জিত হামলায় বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায়। শান রাজ্যের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি নিয়ে এই জোট গঠিত। যাদের ডাকা হয় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে। ২০১৯ সাল থেকে তারা একসঙ্গে কাজ করছে।

তিনটি বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলো আরাকান আর্মি। এদের সবকিছু নিয়মিত সেনাবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গোষ্ঠীর অনেক সদস্য রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু জাতি রোহিঙ্গা। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি বা এমএনডিএএ-এর যোগসূত্র কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে। দলটি কোকাং জনগণের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে। টিএনএলএ-এ একটি রাজনৈতিক সংগঠন। যাদের বেশিরভাগ সদস্যই যোদ্ধা।

চীন-মিয়ানমার সীমান্তে মানবপাচার ও সাইবার অপরাধ ঠেকাতে জান্তা সরকারের কাছে বার বার আবেদন করেও সহায়তা পায়নি চীন। তাদের দমনে অঙ্গীকার করে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। ইতোমধ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি শান রাজ্যে থেকে ২০০টির মতো প্রতারক চক্রকে পরাস্ত করে। বিনিময়ে বেইজিংয়ের সমর্থন কেড়ে নেয় ব্রাদারহুড গ্রুপ।

প্রথম দিকে জোটটি শান ও রাখাইন রাজ্যে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। এরপর তারা জাতীয় ঐক্য সরকার নাগসহ বিভিন্ন জাতিগত গ্রুপ ও দলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। মিয়ানমারে জনপ্রিয় গোষ্ঠী নাগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও এর প্রতিনিধি অফিস আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সংকট গভীর হবার অন্যতম কারণ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সক্রিয় প্রতিবাদ। বিদ্রোহীদের প্রতিবাদের সমর্থন জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও অনেকটা চুপ। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। জান্তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেকে।

এসএস