সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ভারতের মধ্যপ্রদেশের এক ছোট্ট শহরে কয়েকটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এক থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ১৯টি শিশু মারা যায়। মৃত্যুর কারণ জানতে খাবার পানি থেকে মশা, সবকিছুই পরীক্ষা করা হয়।
অসুস্থ শিশুদের অভিভাবকদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমার বাচ্চার স্বাভাবিক ঠাণ্ডা লেগেছিল। আমরা তাকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী “কোল্ডরিফ” সিরাপ খাওয়াতে থাকি। দুই দিন সিরাপ খাওয়ানোর পর সে বমি করতে শুরু করে। হাসপাতালে ভর্তি করার পর আমাদের বাচ্চা প্রস্রাব করা বন্ধ করে দেয়। চিকিৎসা চলাকালীন, ছয় থেকে সাত দফা ডায়ালাইসিস করার পর আমাদের সন্তান মারা যায়।’
শুরুতে কর্মকর্তারা পানির নমুনা থেকে শুরু করে মশা পর্যন্ত পরীক্ষা করেন। পরে জানা যায়, ওই শিশুদের কিডনি বিকলে মৃত্যু হয়েছিল।
কয়েক সপ্তাহ পর দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই শহরের একটি সরকারি পরীক্ষাগারের পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। শিশুদের খাওয়া সিরাপটিতে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ ‘ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকোল’ নামের এক বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে—শিল্প কারখানায় ব্যবহার করা বিষাক্ত এ উপাদানটি কোনো ওষুধে থাকা উচিত নয়। এ রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করলে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে মৃত্যু হতে পারে।
পুলিশ সুপারিনডেন্ট অজয় পাণ্ডে বলেন, ‘ভুপাল থেকে আসা ল্যাব রিপোর্ট অনুযায়ী কাশির সিরাপে ‘ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকোল’ উপাদান অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ছিল এবং তাই শিশুরা মারা গেছে।’
আরও পড়ুন:
প্রতিবেশি রাজ্য রাজস্থানেও দুই শিশুর মৃত্যু হয়। তারাও স্থানীয়ভাবে তৈরি ডেক্সট্রোমেথ্রোফ্যান সিরাপ খেয়েছিল।
এই ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় আন্দোলন। পরিস্থিতি সামলাতে শিশুদের ওষুধ প্রয়োগে ডাক্তারদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে সিরাপের নমুনা জব্দ করে বিক্রি বন্ধের পাশাপাশি তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
তবে ভারতের জন্য এটি নতুন কিছু নয়। বিগত বছরগুলোতে দেশটিতে তৈরি কফ সিরাপে ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকোলের উপস্থিতির কারণে বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে এমন সিরাপের কারণে গাম্বিয়ায় ৭০ জন এবং উজবেকিস্তানে ১৮ জন শিশুর মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মু এলাকায় অন্তত ১২ শিশুর মৃত্যু ঘটে একইভাবে। ধারণা করা হয়, সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
প্রতিবার এমন ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কিছুদিন পরই বাজারে আবারও ভেজাল সিরাপ ফিরে আসে। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে ভারতের জটিল ও দুর্বল ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যেখানে ছোট ছোট ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অল্প খরচে অনুমোদনহীন সিরাপ তৈরি করে অবাধে বিক্রি করে।
সমালোচকরা বলছেন, ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বল তদারকি, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, আর বাজারে সিরাপের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ভারতীয় বাজারের একটি বিশাল জায়গা দখল করে ওষুধ শিল্প।
গতবছর দেশটির কফ সিরাপের বাজার ছিল ২৬২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩৫ সালে এটি বেড়ে ৭৪৩ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।





