যে আহমেদ আল-শারার মাথার দাম ধার্য করা হয়েছিল ১ কোটি মার্কিন ডলার, মধ্যপ্রাচ্য সফরে সেই তরুণ নেতার বুদ্ধি আর স্বাধীনতাকামী চেতনার ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়ে হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এই আহমেদ আল শারা ছিলেন সিরিয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শাম বা এইচটিএসের জনপ্রিয় নেতাদের একজন। যে সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল আল কায়দা।
আহমেদ আল শারার বিরুদ্ধে নারী ও শিশুসহ মার্কিন সেনাসদস্য হত্যার অভিযোগ আনার পাশাপাশি ২০১৮ সালে এইচটিএসকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ, আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি নামে পরিচিত এই আহমেদ আল শারার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল আল কায়দার।
গেল ডিসেম্বরে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক আহমেদ আল শারাকে গ্রেপ্তারের জন্য ১ কোটি ডলার পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাটি প্রত্যাহার করে ওয়াশিংটন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ফ্রান্স ও সৌদি আরবের মতো দেশে সফরের সুযোগ পান সিরিয়ার অন্তর্বর্তী এই সরকার প্রধান।
বিশেষ করে ট্রাম্পের ৪ দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর ও আরব নেতাদের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুসুলভ আচরণ- জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্নের। বিরোধী ডেমোক্র্যাট শিবির বলছে, মার্কিন নাগরিকদের রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে আপোস করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, বাশার আল আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার রাজনীতিতে যে নতুন পালাবদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ট্রাম্পের মতো বিশ্বনেতার স্বীকৃতি বড় একটি ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আরব নেতারা সিরিয়ার বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না। তাই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা করে গালফ রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন কূটনৈতিক বোঝাপড়া সেরে নিলেন ট্রাম্প, তেমনি জ্বালানি সমৃদ্ধ সিরিয়ার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে দৃশ্যমান একটি পদক্ষেপও নিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক নাতাশা হল বলেন, ‘রিয়াদ থেকে সর্বসাধারণের জন্য এই ঘোষণা এসেছে। এটা গালফ রাষ্ট্রগুলোকে একধরণের সবুজ সংকেত দেয়। যারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য সিরিয়ায় বিনিয়োগ করতে পারছিলেন না তারা বিষয়টি নিয়ে এখন থেকে ভাবতে পারেন।’
সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের পরিচালক জশুয়া লান্ডিস বলেন, কূটনৈতিকভাবেও এটা আহমেদ আল শারার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে তার সরকার কখনোই দেশ চালাতে পারবে না। সিরিয়ায় অর্থনীতিতে নতুন জাগরণ আনতে হলেও এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রয়োজন ছিল।’
১৯৭১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আল আসাদের শাসনামলে ক্ষমতা ধরে রাখার রাজনীতিতে বড় ভূমিকা ছিল ইরান ও রাশিয়ার। সরকারী বিরোধী বিক্ষোভ ও কার্যক্রম বন্ধে তেহরান ও মস্কোকে পাশে পেয়েছে দামেস্ক।
সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য রুশ সেনাদের জায়গা ছেড়ে দিতেও কার্পণ্য করেননি বাশার আল আসাদ। সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দেয়ায় ১৯৭৯ সালে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৪ সালে অস্ত্র রপ্তানিতে বিধিনিষেধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়ার অর্থনৈতিক যোগাযোগের উপর সীমাবদ্ধতা আরও বাড়িয়ে দেয় ওয়াশিংটন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও ইরান-রাশিয়ার আধিপত্য কমাতে বিরোধীদের চটিয়ে হলেও দামেস্কের সঙ্গে সমঝোতা করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাই একসময়ের শত্রুর সঙ্গে হাত মেলানোকে ট্রাম্পের কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় হিসেবেই দেখছেন তারা।