রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বিনিময়ে দেশটির সমৃদ্ধ রেয়ার আর্থ বা বিরল মৃত্তিকা মৌল ও খনিজ সম্পদের দিকে তাকিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গেল সপ্তাহে ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনামে রেয়ার আর্থ।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের বিবেচনায় বিভিন্ন ধরনের রেয়ার আর্থ, নিকেল ও লিথিয়ামসহ ৫০ ধরনের খনিজ ধাতু গুরুত্বপূর্ণ তালিকাভুক্ত। এসব ধাতুর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তালিকায় থাকা ৩৪টি ধাতুর মধ্যে ২২টির মজুত রয়েছে ইউক্রেনে।
কয়লারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মজুদ ছিল দেশটিতে, যা বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় খনিজ সম্পদ বেহাত হওয়ার শঙ্কায় ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘এসব খনিজ সম্পদ খনন থেকে রাশিয়াকে আটকাবো আমরা। না হলে দেশটি অশুভ অক্ষের তিন দেশের জন্য নতুন প্রযুক্তি উৎপাদনে এসব খনিজ সম্পদ ব্যবহার করে ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই সবচেয়ে বেশি থাকা উচিত আমাদের। ইউক্রেন পুনর্গঠনেও তাদেরই অগ্রাধিকার দেবো।’
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি, ইউক্রেনের মোট খনিজ সম্পদের ২০ শতাংশেরও কম রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। তবে এর মধ্যে ইউক্রেনের রেয়ার আর্থের মোট মজুতের প্রায় অর্ধেক পড়ে গেছে রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে।
এমন পরিস্থিতিতেই এক সময় ইউক্রেনের রেয়ার আর্থ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের গোপন ও স্পর্শকাতর মানচিত্র শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে উন্মুক্ত করেন প্রেসিডেন্ট। আগ্রহ জানান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ চুক্তির।
ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘এই ভূগর্ভস্থ মজুত অমূল্য। বিপুল পরিমাণ অর্থের খনি এগুলো। তাই এগুলোকে রক্ষা করা দরকার। কাজেই যদি আমরা চুক্তির কথা বলি, যেটা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, তো চলুন চুক্তি করি।’
রেয়ার আর্থ- ১৭ ধরনের রুপালি শুভ্র ধাতব মৌল পড়ে এর কাতারে। একেবারে দুর্লভ না হলেও প্রকৃতিতে রেয়ার আর্থ ভুক্ত উপাদানগুলো অভিন্ন অবস্থায় মেলে এবং এগুলোকে আলাদা করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল।
প্রযুক্তি খাতে এসব ধাতব মৌলের কোনো বিকল্প আজও মেলেনি। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, মুঠোফোন, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনে জরুরি রেয়ার আর্থ, যেগুলো বিদ্যুৎ শক্তিকে গতিতে রূপ দিতে চুম্বক নির্মাণে ব্যবহার করা হয়।
কিয়েভের দাবি, বিমান ও মহাকাশ প্রযুক্তি শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টাইটানিয়াম এবং পারমাণবিক জ্বালানি ও অস্ত্র খাতে গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেলে ইউক্রেনে।
এর মধ্যে টাইটানিয়ামের বড় মজুত রয়েছে ইউক্রেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, যা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেকটা দূরে। তবে এসব খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে ইউক্রেনে ঢুকতে হবে মার্কিন প্রশাসনকে।
জার্মানির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জ্যাকব কুলিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যে ইউক্রেনের খনি এবং খনিজ উপাদান বিশ্লেষণের উপযুক্ত মার্কিন প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি দেশটিতে তেমন নেই। কারণ প্রায় দুই দশক ধরে ইউক্রেনের এ খাত নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। তাই রাজনৈতিকভাবে এটা বলা সহজ যে চলো ইউক্রেন থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো নিয়ে আসি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ চলতে থাকার মধ্যে মার্কিন, ব্রিটিশ বা জার্মান কিংবা যেকোনো প্রতিষ্ঠান এ কাজ করতে পারবে, তা এখন বোঝার কোনো উপায়ই নেই।’
সারা বিশ্বে রেয়ার আর্থসহ আরো অনেক দুর্লভ খনিজ সম্পদের সবচেয়ে বড় মজুত রয়েছে চীনে। যে দেশটির সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়মিত।
রেয়ার আর্থের বিপুল মজুত লুকিয়ে ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ডের মাটিতেও, যেকারণে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ দ্বীপটি দখলেরও হুমকি দিচ্ছেন ট্রাম্প। তবে নানা কারণে রেয়ার আর্থ পেতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্ভাব্য ভালো বিকল্প ইউক্রেন।
ড. জ্যাকব কুলিক বলেন, ‘ট্রাম্প এসব রেয়ার আর্থ চাইছেন কারণ এর জন্য মার্কিন অর্থনীতি ভীষণরকম চীন নির্ভর। এটি এক ধরনের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিও বটে। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে রেয়ার আর্থ খনন ও উত্তোলনের মতো মার্কিন প্রতিষ্ঠান খুব একটা নেই। এর মধ্যে ইউক্রেন মিত্র দেশ আর সেখানে জরুরি পণ্যগুলো আছে। চীন যেন ইউক্রেনের রেয়ার আর্থ উপাদানগুলো দখলে নিতে বা খনন শুরু করতে না পারে, তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ভালো বিকল্প। আর মার্কিন সামরিক সহায়তার জন্য ইউক্রেনের কাছ থেকে বিনিময় মূল্যও চায় যুক্তরাষ্ট্র।’
ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দিলেও নিজেদের রেয়ার আর্থের মজুত অবশ্য বিলিয়ে দিতে রাজি নন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এ খাতে দুপক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়, এমন চুক্তি প্রণয়নের আহ্বান কিয়েভের।