যুদ্ধ কবলিত সিরিয়ায় সংঘাতের ইতি টানার লক্ষ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক শাসন নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল সেই ২০১৫ সালে। দশক পেরোতে নেই সেই প্রস্তাব কার্যকরের কোনো লক্ষণ। গৃহযুদ্ধের ১৩তম বছরে নতুন করে পরিস্থিতির অবনতি বহু পক্ষের সংঘাত দমনচেষ্টার সমন্বিত ব্যর্থতার প্রমাণ বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত গেইর পিডারসেন।
শান্তির সম্ভাবনা ধরাছোঁয়ার বাইরে, সংঘাত অব্যাহত থাকলেও কয়েক বছর ধরে নেই কোনো পরিবর্তন। বিদেশি শক্তির সামরিক উপস্থিতি আছে যতগুলো জায়গায়, ততোগুলো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশটি। উত্তরে তুরস্ক, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে লেবানন ও ইসরাইল, পূর্বে ইরাক এবং দক্ষিণে জর্ডান নিকটতম প্রতিবেশী। এসব দেশ তো বটেই ইরান, যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মতো পরাশক্তিরাও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকট ঘিরে সৃষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সংঘাতে।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়ার সবচেয়ে বড় অংশে প্রভাব রাশিয়া আর ইরানের। দেশের উত্তরপূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস বা এসডিএফকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কুর্দিদের ঠেকাতে আসাদ বিরোধী অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছে প্রতিবেশী তুরস্কের সেনারা। মাঝে কয়েক বছর এসব শক্তির সমতা বজায় থাকলেও গাজা-লেবাননে ইরান সমর্থিত বাহিনীর সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাতের জেরে এক বছরের বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় টালমাটাল আঞ্চলিক ও বহিঃশক্তির ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। যার জেরে গত এক সপ্তাহে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের মদদপুষ্ট আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের নাটকীয় উত্থান।
আটলান্টিক কাউন্সিল সিরিয়া প্রজেক্টের ফেলো ওমর ওজকিজিলচিক বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে আসাদ সরকার ও সিরীয় বিদ্রোহীদের আলোচনার টেবিলে এক করার চেষ্টা করেছে তুরস্ক। বারবার দামেস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক সমাধান এবং সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় চাপ দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো যে দামেস্ক এতে প্রস্তুত নয় এবং ইরান কিংবা রাশিয়াও দামেস্ককে গঠনমূলক আলোচনার জন্য রাজি করাতে পারেনি।’
২০২০ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সংঘাত বন্ধে আসাদ সরকারের ব্যর্থতার জন্য ক্রমশ হতাশা বাড়ছিল আঙ্কারায়। প্রতিবেশী দেশের এ অবস্থা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া তুরস্ক কুর্দি সংগঠন ওয়াইপিজি'র বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে চায় সিরিয়ায়, যে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে আসাদ সরকারের মিত্র রাশিয়া ও ইরান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে তুরস্কের কাছে স্পষ্ট বার্তা গেছে যে আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনা কম। এরপরই তুর্কি প্রশাসনের সবুজ সংকেত পেয়ে অপ্রত্যাশিত আঘাত হেনেছে আসাদ বিরোধীরা। ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্রোহীদের দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট আসাদও।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ফেলো ড. এইচ এ হেলিয়ার বলেন, ‘আমার মনে হয় যে নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ দেখাবেন তিনি। যেভাবেই হোক না কেন, বিদ্রোহীদের এগোনো ঠেকাতে চান তিনি। প্রয়োজনে পিষে মারতে চাইবেন বিদ্রোহীদের। কিন্তু আসলে যে তা সম্ভব নয়, শেষ পর্যন্ত তা তিনি বুঝবেন কি না, এটাই প্রশ্ন।’
গেলো সপ্তাহে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ হারানো সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো বিদ্রোহীমুক্ত করতে ২০১৬ সালে আসাদ সরকারকে সহযোগিতা করেছিল লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন, ইরান সমর্থিত, হিজবুল্লাহ। ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে গেলো দু'মাসে বড় ধাক্কা খেয়ে এ পর্যায়ে নীরব গোষ্ঠীটি। তবে এখনও সিরীয় সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া ও ইরান।