একদিনেই ঘুরে আসুন ঢাকার আশপাশের ২০টি দর্শনীয় স্থান

ঢাকার আশপাশের সেরা ২০ টি দর্শনীয় স্থান: এক দিনের পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ গাইড, খরচ ও যাতায়াত সহ
ঢাকার আশপাশের সেরা ২০ টি দর্শনীয় স্থান: এক দিনের পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ গাইড, খরচ ও যাতায়াত সহ | ছবি: এখন টিভি
0

ব্যস্ত নগরী ঢাকার যান্ত্রিক জীবন থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিতে চান? তাহলে আপনার জন্য রইল এক দারুণ সুযোগ। রাজধানী থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে এমন ১৬টি মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে, যেখানে আপনি একদিনেই ঘুরে এসে (One-Day Getaway) সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ফিরতে পারবেন। ইতিহাস, প্রকৃতি, নির্মল বাতাস এবং অ্যাডভেঞ্চার—সবকিছুই পাবেন আপনার এই স্বল্প সময়ের ভ্রমণে।

নিচে ঢাকার আশপাশের জনপ্রিয় স্থানগুলো তিনটিভাগে (ঐতিহাসিক ও প্রাচীন স্থাপত্য, প্রকৃতি-পার্ক ও বিনোদন, জলপথের আকর্ষণ ও রিসোর্ট) বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

ঢাকার আশপাশের সেরা দর্শনীয় স্থান: এক দিনের পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ গাইড, খরচ ও যাতায়াত সহ |ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহাসিক ও প্রাচীন স্থাপত্য (Heritage & Ancient Architecture)

এসব স্থানে গেলে আপনি বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও স্থাপত্যের সাক্ষী হতে পারবেন।

১. পানাম নগর (Panam City)

৪০০ বছরের পুরোনো এই নগরীটি ছিল বাংলার একসময়ের রাজধানী। এখানকার প্রায় ৫২টি জীর্ণ দালান বা ভবন মোগল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ বহন করে। গুলিস্তান থেকে বাস/সিএনজি করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও যেতে হবে। প্রবেশ ফি সাধারণত ৩০-৫০ টাকা। সোনারগাঁও জাদুঘরের সঙ্গে এটি একই দিনে ঘুরে দেখা ভালো।

আরও পড়ুন:

২. সোনারগাঁও জাদুঘর (Sonargaon Museum)

পানাম নগরের খুব কাছে অবস্থিত এই জাদুঘরে রয়েছে লোক ও কারুশিল্পের বিশাল সংগ্রহ, যা গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ফুটিয়ে তোলে। পানাম নগর থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়। পানাম সিটির সঙ্গে এই স্থানটি ভ্রমণ করলে সময় সাশ্রয় হবে।

৩. বালিয়াটি জমিদারবাড়ি (Baliati Zamindar Bari)

মানিকগঞ্জে অবস্থিত এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং প্রাচীন জমিদার বাড়ি। এটি চারটি বড় কাঠামো এবং সাতটি প্রাঙ্গণ নিয়ে গঠিত, যা ঊনবিংশ শতকের জমিদারী শান-শওকতের নিদর্শন। গাবতলী থেকে বাসযোগে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া যেতে হবে।প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। ঢাকার পশ্চিম দিকের জন্য এটি সেরা ঐতিহাসিক গন্তব্য।

৪. মহেরা জমিদার বাড়ি (Mohera Zamindar Bari)

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি তার চমৎকার স্থাপত্যশৈলী ও সুসজ্জিত বাগানের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে এটি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহাখালী থেকে টাঙ্গাইলগামী বাসে চড়ে মির্জাপুরে নামতে হবে। পারিবারিক ডে-আউটের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রবেশ ফি প্রয়োজন হয়।

৫. শালবন বৌদ্ধ বিহার (Shalban Bihar)

কুমিল্লায় অবস্থিত এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারটি সপ্তম-অষ্টম শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর ধ্বংসাবশেষগুলো বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ও স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করে। ঢাকা থেকে কুমিল্লাগামী যেকোনো বাসে যেতে পারেন। এটি ময়নামতি এলাকার খুব কাছে।

৬. বড় কাটরা: মোগল স্থাপত্যের এক নীরব সাক্ষী (Boro Katra: Mughal History)

১৬৪৪ সালে মোগল সুবাহদার শাহ সুজার নির্দেশে তার প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসিম দ্বারা নির্মিত এই ঐতিহাসিক ভবনটি একসময় ছিল একটি বিশাল বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও সরাইখানা। এটি মোগল স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। বর্তমানে এর কেবল ভগ্নদশা অবশিষ্ট থাকলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি পুরোনো ঢাকার চকবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে সরাসরি রিকশা বা সিএনজিতে চকবাজার এসে বড় কাটরা যাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

৭. নকশীপল্লী: লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের মিলনমেলা (Nakshipolli: Folk Art Hub)

লোকশিল্প ও কারুশিল্পের প্রতি আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য নকশীপল্লী একটি দারুণ গন্তব্য। এখানে স্থানীয় কারিগরদের হাতে তৈরি নকশী কাঁথা, মাটির পাত্র, বাঁশ ও বেতের কাজ এবং অন্যান্য হস্তশিল্প প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। এটি গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরে। সাধারণত বিভিন্ন জেলা বা স্থানে স্থানীয় উদ্যোগে এই ধরনের পল্লী গড়ে ওঠে। (নকশীপল্লীর একটি জনপ্রিয় ধারণা সাভার বা গাজীপুরের দিকে দেখা যায়)। হাতে তৈরি শিল্পকর্ম কেনার সুযোগ থাকে।

একদিনেই ঘুরে আসুন ঢাকার আশপাশের মনোমুগ্ধকর স্থানে |ছবি : সংগৃহীত

প্রকৃতি, পার্ক ও বিনোদন (Nature, Park & Adventure)

পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ও বিনোদন উপভোগের জন্য এই গন্তব্যগুলো আদর্শ।

৮. জিন্দা পার্ক (Zinda Park)

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত এটি একটি পরিকল্পিত ইকো-পার্ক। পাঁচটি লেক, বিশাল সবুজ বন ও পরিকল্পিত পথ এই পার্কের মূল আকর্ষণ। এটি ফটোগ্রাফি ও বনভোজনের জন্য খুবই জনপ্রিয়। কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচ থেকে অটোরিকশা/বাসে কাঞ্চন সেতু। প্রবেশ ফি সাধারণত ১০০-১৫০ টাকা। এখানে লেকে নৌকা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

৯. নুহাশ পল্লী (Nuhash Polli)

গাজীপুরে অবস্থিত এটি প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ি। এখানে তাঁর তৈরি ভাস্কর্য, সুইমিং পুল, ঔষধি গাছের বাগান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ মনকে শান্তি দেয়। গাজীপুরের হোতাপারা থেকে সহজেই যাওয়া যায়। প্রবেশ ফি প্রয়োজন। যারা নিরিবিলি ও গাছপালা ভালোবাসেন, তাদের জন্য আদর্শ।

আরও পড়ুন:

১০. বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক (Bangabandhu Safari Park)

গাজীপুরের এই বিশাল সাফারি পার্কে উন্মুক্ত পরিবেশে বাঘ, সিংহ, জেব্রাসহ নানা বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। সাফারির জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী বাসে চড়ে বাঘের বাজার এলাকায় নামতে হবে।

১১. ড্রিম হলিডে পার্ক (Dream Holiday Park)

নরসিংদীতে অবস্থিত এই থিম পার্কটি আধুনিক রাইড, ওয়াটার পার্ক এবং বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারমূলক খেলার জন্য পরিচিত। ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী বাসে ভেলানগর নামতে হবে।

১২. সোহাগপল্লী (Sohagpolli)

গাজীপুরের একটি জনপ্রিয় রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট। এর সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ ও রিসোর্ট সুবিধা পারিবারিক বা কর্পোরেট ডে-আউটের জন্য চমৎকার।

১৩. জল ও জঙ্গলের কাব্য

গাজীপুরের এই রিসোর্টটি প্রাকৃতিক পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে। এখানে কটেজ ও গ্রামীণ পরিবেশে একদিন প্রকৃতির সঙ্গে মেশার সুযোগ রয়েছে। এখানে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই আগাম বুকিং নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকার কাছাকাছি: ইতিহাস, প্রকৃতি ও বিনোদনের নতুন ঠিকানা |ছবি : সংগৃহীত

জলপথের আকর্ষণ ও রিসোর্ট (Riverside Beauty & Resorts)

যারা নদী, নৌকা এবং জলরাশির বিশালতা উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য এই গন্তব্যগুলো সেরা।

১৪. মৈনট ঘাট (Moinot Ghat, দোহার)

পদ্মা নদীর বিশাল জলরাশির কারণে এটি 'মিনি কক্সবাজার' নামে পরিচিত। সূর্যাস্ত দেখতে এবং ট্রলারে নদীতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এটি খুবই জনপ্রিয়। গুলিস্তান থেকে সরাসরি "যমুনা" বা "এন মল্লিক" বাসে যেতে পারেন। বাসের ভাড়া ১০০-১৫০ টাকা।

১৫. পদ্মা রিসোর্ট (Padma Resort, মুন্সিগঞ্জ)

পদ্মা নদীর পাড়ে তৈরি শান্ত ও মনোরম রিসোর্ট। এখানে থাকার এবং দিনের বেলা ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের লোহাজং এলাকায় অবস্থিত।

আরও পড়ুন:

১৬. মেঘনার পার (Meghnar Par)

নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মেঘনা নদীর বিস্তৃত পাড়, নৌকা ভ্রমণ এবং খোলা বাতাস উপভোগের সুযোগ রয়েছে।

১৭. বঙ্গবন্ধু সেতু রিসোর্ট (Bangabandhu Setu Resort)

যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই রিসোর্ট থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর বিশালতা দেখা যায়।

১৮. আশুলিয়া এবং বালু নদী

সাভারের আশুলিয়া বিল এবং ঢাকার পূর্ব দিকের বালু নদীতে গ্রামীণ পরিবেশে নৌকা ভ্রমণ ও নদীর শান্ত দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

১৯. বুড়িগঙ্গা ইকো পার্ক: নদীর তীরে প্রকৃতির ছোঁয়া (Buriganga Eco Park)

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে এই পার্কটি তৈরি করা হয়েছিল। যদিও নদীর দূষণের কারণে পার্কটির আকর্ষণ কিছুটা কমেছে, তবুও নদীর তীরবর্তী এলাকায় কিছুটা সবুজের ছোঁয়া ও শিশুদের খেলার ব্যবস্থা এখানে পাওয়া যায়। এটি কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় অবস্থিত। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে সহজে এখানে পৌঁছানো যায়।

২০. মানা বে ওয়াটার পার্ক: আধুনিক জলক্রীড়ার আনন্দ (Mana Bay Water Park: Modern Fun)

ঢাকার আশেপাশে তৈরি হওয়া আধুনিক ওয়াটার পার্কগুলোর মধ্যে মানা বে ওয়াটার পার্ক অন্যতম। এখানে বড়দের ও ছোটদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রোমাঞ্চকর ওয়াটার স্লাইড, সুইমিং পুল এবং রিলাক্স করার সুযোগ রয়েছে। গরমের দিনে এটি দারুণ বিনোদন কেন্দ্র। এটি গাজীপুর বা তার কাছাকাছি কোনো এলাকায় অবস্থিত। গাজীপুরগামী বাসে চড়ে বা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। পার্কে প্রবেশ এবং রাইডগুলোর জন্য উচ্চ প্রবেশ ফি প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন:

একদিনেই সবগুলো স্থান ঘোরা সম্ভব নয়। তাই ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী (যেমন: গাজীপুর সার্কেল, নারায়ণগঞ্জ সার্কেল বা নদীর তীরবর্তী সার্কেল) স্থান নির্বাচন করুন। সাধারণত জনপ্রতি ১,০০০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকা বাজেট রাখলে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে আসতে পারবেন। মনে রাখবেন, ভোর ৬-৭টার মধ্যে রওনা দিলে দিনের আলোয় পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ঘোরা সম্ভব হবে।

দূরত্ব অনুযায়ী বাস, সিএনজি বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করুন। রিসোর্টগুলোতে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যান। পর্যাপ্ত পানীয় জল, শুকনো খাবার এবং রোদ থেকে বাঁচার জন্য ক্যাপ বা ছাতা সঙ্গে রাখুন।

এসআর