এবারের প্রতিপাদ্য— ‘শক্তি ও পুষ্টিতে ভরপুর ডিম’। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্পের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (ওয়াপসা)-বাংলাদেশ শাখা যৌথভাবে রাজধানীতে আয়োজন করছে র্যালি, আলোচনা সভা ও সচেতনতামূলক প্রচারণা।
ডিমের পুষ্টিগুণ: একটিতে যত কিছু
ডিমকে বলা হয় ‘প্রকৃতির পারফেক্ট ফুড’। কারণ একটি মাঝারি ডিমেই থাকে শরীরের প্রয়োজনীয় প্রায় সব পুষ্টি উপাদান। এতে রয়েছে উচ্চমানের প্রোটিন (৬ থেকে ৭ গ্রাম), ভিটামিন এ, ডি, ই, ও বি১২; আয়রন, ফসফরাস, জিঙ্ক, সেলেনিয়ামসহ প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান এবং ‘গুড ফ্যাট’ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিমে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরের কোষ গঠন, পেশি বৃদ্ধি, হরমোন তৈরি ও রোগ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, একজন মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে বছরে অন্তত ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রাপ্যতা এখন গড়ে ১৩৭টি ডিম প্রতি মাথায়, যা গত এক দশকে বড় অর্জন।
বাংলাদেশের ডিম বিপ্লব
দুই দশক আগেও ডিম ছিল অনেকের কাছে বিলাসদ্রব্য। গ্রামাঞ্চলে সপ্তাহে একবার হয়তো ডিম খাওয়ার সুযোগ মিলত। কিন্তু সময় পাল্টেছে। দেশে এখন ডিমের উৎপাদনে এক বিপ্লব ঘটেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে দেশে ডিম উৎপাদন ছিল ৫৬০ কোটি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২০০ কোটিতে। এই প্রবৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে দেশের লাখো ছোট ও মাঝারি পোল্ট্রি খামার।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) বলছে, দেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। আর এই শিল্পে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ৫০ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত।
বিশ্বে ডিমের চাহিদা
বিশ্বজুড়েই ডিম একটি জনপ্রিয় খাবার। জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ব্রাজিল— এই দেশগুলোতে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ বছরে ৩০০টির বেশি। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে এই হার এখনও কম, কিন্তু দ্রুত বাড়ছে। ডিম শুধু পুষ্টির উৎস নয়, বরং এটি খাদ্যনিরাপত্তার প্রতীক। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অপুষ্টি মোকাবিলায় ডিমকে ‘সুপারফুড ফর অল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিশুদের পুষ্টি ও ডিম
শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণে ডিম হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর খাদ্য। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় শিশুরা যেভাবে প্রোটিন ও ভিটামিনের অভাবে ভোগে, সেখানে প্রতিদিন একটি ডিম অনেক পার্থক্য আনতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন একটি ডিম খেলে শিশুর মানসিক বিকাশ, দৃষ্টিশক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের জন্যও এটি নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় খাদ্য।
সরকারের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে মাথাপিছু ডিম ভোগ ১৬৫টি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২০৮টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে। এজন্য প্রণিসম্পদ অধিদপ্তর খামারিদের প্রশিক্ষণ, সাশ্রয়ী খাদ্য সরবরাহ ও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
এছাড়া ‘এক ডিম প্রতিদিন, অপুষ্টি হবে বিদায়’— এই স্লোগানে চলছে জাতীয় প্রচারণা, যার মূল লক্ষ্য ডিম খাওয়ার অভ্যাসকে পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ করে তোলা।
ডিম নিয়ে মিথ ও সত্য
অনেকে এখনও ডিম নিয়ে নানা ভুল ধারণা পোষণ করেন; যেমন, প্রতিদিন ডিম খেলে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিদিন একটি ডিম খাওয়া একেবারেই ক্ষতিকর নয়। বরং এটি শরীরের ‘ভালো কোলেস্টেরল’ বাড়াতে সহায়ক।
ছোট্ট ডিমে বড় ভবিষ্যৎ
ডিম শুধু একটি খাবার নয়; এটি পুষ্টি, শক্তি ও জীবিকার উৎস। কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা— সবার জীবনের সঙ্গে ডিমের সম্পর্ক গভীর। আজকের বিশ্ব ডিম দিবস তাই শুধু ডিমের প্রশংসা নয়; এটি পুষ্টি নিরাপত্তা, দারিদ্র্য হ্রাস ও টেকসই উন্নয়নের এক প্রতীক। একটি ছোট্ট খোলসের ভেতরে যে শক্তি, তা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারই হতে পারে সুস্থ, সবল ও স্বনির্ভর।





