খুলনার শিরোমনি এলাকায় ভৈরব নদীর পাড় ঘেঁষে বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে সারি সারি দেশি-বিদেশি নানা গাছের মনোরম দৃশ্য।
প্রতিটি প্লান্টে বিরামহীনভাবে চলছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলো। শ্রমিকের স্পর্শ ছাড়াই এখান থেকে তৈরি হচ্ছে টেলিযোগাযোগ তারসহ নানা রকম ক্যাবল।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও পশ্চিম জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এই ক্যাবল কারখানা স্থাপন করা হয়। তবে ১৯৭২ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে আন্তর্জাতিক মানের টেলিযোগাযোগ কপার ক্যাবল উৎপাদনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
এখানকার প্রধান উৎপাদনশীল পণ্য টেলিযোগাযোগ কপার ক্যাবল। এই তার তৈরির প্রধান কাঁচামাল কপার রড আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া ও কোরিয়া থেকে। আমদানিকৃত ৮ মিলিমিটার কপার রড স্বয়ংক্রিয় হেভি ড্রয়িং মেশিনের মাধ্যমে বানানো হয় নানা সাইজে। এখানে ড্রপ ওয়্যার ও টিপ ক্যাবল নামে ২ ধরনের কপার ক্যাবল উৎপাদন করা হয়। যা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ১০.২ থেকে শুরু করে ২৪শ' পেয়ার তারে রূপ দেওয়া হয়। পরে তা ড্রামে জড়িয়ে সরবরাহ করা হয় সারা দেশে।
বর্তমানে ১ লাখ কন্ডাক্টর কিলোমিটার কপার ক্যাবল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৫ হাজার ৬৫৬ কন্ডাক্টর কিলোমিটার তার উৎপাদন করা হয়। যা বিক্রি করা হয় ১৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকায়।
খুলনা বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক খান অরিন মো. শুভ বলেন, 'কপার ক্যাবলের প্রধান গ্রাহক হচ্ছে বিটিসিএল। এছাড়া মেট্রেরেলেও কপার ক্যাবল যাচ্ছে।'
এ ছাড়া ক্যাবল শিল্পে অপটিক্যাল ফাইভারের তার উৎপাদনের পর থেকেই চাহিদার শীর্ষে রয়েছে এটি। জাপান ও চায়না থেকে এই তারের মূল উপকরণ ফাইবার আমদানি করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এখানে ১ লাখ ৬৪ হাজার ফাইবার কিলোমিটার তার উৎপাদন হয়। তবে চাহিদা বাড়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৪২ ফাইবার কিলোমিটারে। যার বাজার মূল্য ১৩২ কোটি ৩৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মোস্তফা হাসান বলেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ক্যাবলের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা পাচ্ছি।'
তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে ২০১৯ সালে ক্যাবল শিল্পে পাওয়ার ক্যাবল প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এই পাওয়ার ক্যাবল তৈরির প্রধান কাঁচামাল অ্যালমুনিয়াম ও স্টিল কপার। যা চায়না, দুবাই বা তাইওয়ান থেকে আমদানি করা হয়। এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক ওভারহেড কন্ডাক্টার, সার্ভিস ড্রপ ক্যাবল ও বেয়ার ক্যাবল তৈরি করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৫৭১ কিলোমিটার ক্যাবল সরবরাহ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য ১৩ কোটি টাকা। এছাড়াও ফাইভার অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের জন্য প্রয়োজনীয় প্যাচ কর্ড ও পিগটেইলের মত বেশ কিছু পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডে প্রতি বছরই বাড়ছে লাভের সংখ্যা। ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির মোট আয় ছিলো ১২২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। যা বেড়ে পরবর্তী অর্থবছরে গিয়ে দাঁড়ায় ২০৩ কোটি ১১ লাখ টাকায়।
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. এনামুল হক বলেন, 'অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা বাংলাদেশে। গত বছরে জুলাই থেকে এবছরে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা ১৩ হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার তৈরি করেছি।'
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডে সব মিলিয়ে কর্মরত রয়েছেন ৩১৯ জন, ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জগদীশ চন্দ্র মন্ডল বলেন, '৪ টা পণ্য আছে আরও নতুন দুইটা পণ্য আসবে। এই ছয়টা পণ্য নিয়ে আপাতত আমরা এগোচ্ছি।'
গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড বিটিসিএল এর নানা প্রকল্প, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবিসহ দেশের সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের উৎপাদিত তার সরবরাহ করেছে। ইন্টারনেট ও ল্যান নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত ক্যাবল তৈরিসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের।