কচুরিপানার সঙ্গে পাট, পরিত্যক্ত কাগজ ও সিল্ক কাপড় দিয়ে তৈরি হয় মণ্ড। এরপর তাতে রঙ দিয়ে রোদে শুকানোর পর বানানো হয় কাগজ। সে কাগজ দিয়ে বানানো হয় পুতুলবক্স, খেলনাসহ প্রয়োজনীয় সৌখিন সামগ্রী। কলা গাছের খোল-বাকল দিয়ে কার্ড, কেয়া বা তাল পাতা দিয়ে ঝুড়ি, ব্যাগ এবং ফেলে দেয়া শাড়ি দিয়েও উৎপাদিত হচ্ছে নজরকাড়া বিভিন্ন পণ্য।
কচুরিপানা থেকে কাগজ তৈরির পর বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে এমসিসির উদ্যোগে আগৈলঝাড়ায় গড়ে ওঠে জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রকল্প। এরপরে একে একে গড়ে ওঠে তরুলতা, বিবর্তন হ্যান্ডমেইড পেপার অ্যান্ড ক্রাফট, বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামে আরও ৪টি প্রতিষ্ঠান।
অপ্রয়োজনীয় এই কুচরিপানাই জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে অঞ্জনা রায়ের। স্বামীর সংসারে অভাব থাকায় বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই হস্তশিল্পের কাজ করছেন। তার মত আরও অনেকে নারীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি তাদের তৈরি পণ্য দেশের বাইরে বাজারজাত হওয়ায় খুশি তারা।
কুচরিপনা দিয়ে হস্তশিল্প তৈরি করে স্বাবলম্বী অঞ্জনা রায়।
জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজের ইউনিট ম্যানেজার পাপড়ি মন্ডল বলেন,‘আমরা পেপার থেকে যেসব প্রডাক্ট তৈরি করি তা সরাসরি বিদেশে চলে যায়। ইউরোপ আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি এশিয়ান দেশে আমাদের এই পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে।’
হাতে তৈরি কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্পের নানা ধরনের পণ্য। এগুলো তৈরি করছেন বরিশালের আগৈলঝাড়ার উপজেলার নারীরাই। এই পণ্যগুলোও রপ্তানি করা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যা থেকে আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। আর এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আগৈলঝাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। যার মাধ্যমে বাড়ছে রপ্তানি আয়। পণ্য উৎপাদনে জড়িত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দাবি এই কাজের মাধ্যমে বাড়ছে কর্মসংস্থান, স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। যা টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের তৈরি হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে।
আগৈলঝাড়ার কেয়া পাম হ্যান্ডি ক্রাফট লিমিটেডের ম্যানেজার জগন্নাথ দত্ত বলেন, ‘আমাদের হস্তশিল্পীদের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তৈরি করা গেছে এবং এর মাধ্যমে আমরা একটি ভালো উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’
বিবর্তন হ্যান্ড মেইড পেপার প্রজেক্টের ইনচার্জ অঞ্জন কুমার বলেন, ‘আমাদের সাধারণত ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ থেকে বেশি অর্ডার পেয়ে থাকি। তবে ধারাবাহিকতা সবসময় একরকম থাকে না সেক্ষেত্রে আমাদের বার্ষিক ২ থেকে ৩ কোটি টাকা বিক্রি হয়।’
এই কাজকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পরিবেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আর এ খাত এগিয়ে নিতে স্থানীয় প্রশাসন যেকোনো সহায়তার জন্য প্রস্তুত বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান রিফাত ফেরদৌস বলেন, ‘ এ ধরনের উদ্যোগে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের জাতীয় ও রপ্তানি আয় দুটি একসঙ্গে বাড়ছে। যা আমাদের পরিবেশকেও রক্ষার সঙ্গে আমাদের এনে দিচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারিয়া তানজিন বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগেকে পৃষ্টপোষকতা করার সরকারি দপ্তরগুলো সবসময় সচেষ্ট রয়েছে। তাদের কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের জানালে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তাদের সে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের।’
অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী ও আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি-এমসিসির উদ্যোগে উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্রে প্রথমে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’-এর আওতায় উপজেলার প্রায় ২ হাজার নারীরা বিভিন্ন বাহারি পণ্য উৎপাদনে জড়িত।