বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা ২ থেকে ৩ লাখ টন ওজনের বিশাল জাহাজ বেঁধে রাখা হয় বেশ মোটা আকৃতির দড়ি দিয়ে। এ দড়ির আসলে সক্ষমতা কত?
খাতুনগঞ্জে দড়ির পাইকারি দোকানে আকার আর নকশার ভিন্নতায় শতরকম দড়ি আছে। কাপড় শুকানো থেকে শুরু করে, পণ্য পরিবহন, কৃষিকাজ, পশু পালন থেকে জাহাজ বা নৌকা বাঁধায় দড়ির শত রকম ব্যবহার আছে । কীভাবে তৈরি হয় এ শক্তিশালী দড়ি?
চট্টগ্রাম ইপিজেডে জাপানি মালিকানাধীন বিশ্বমানের দড়ি তৈরির কারখানা বিএমএস রোপ প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে দড়ি তৈরি ও রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। নাইলন, কটন, পলিস্টারের ১০ রকমের বেশি দড়ি তৈরি হয় এ কারখানায়।
দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে জাহাজ। ছবি: এখন টিভি
ভালো মানের দড়ি তৈরিতে প্রথমেই লাগে পলিথিনের গুণগত কাঁচামাল বা রেজিন। এটি আমদানি হয় কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীনসহ নানা দেশ থেকে। সে রেজিন তাপে গলিয়ে বিশেষ মেশিনে পরিচালনা করে তৈরি হয় দড়ির ক্ষুদ্র একক অংশ। দড়িটি কত ভার বহন করবে, স্থায়িত্ব কেমন হবে তা নির্ভর করে পরের ধাপে। ভালো দড়ির জন্য পানির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখাসহ, উপকরণের সঠিক ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিকও।
একজন শ্রমিক বলেন, 'একটা সুতা দিয়ে আমরা তিন থেকে চার কেজি পণ্য উঠাতে পারি। তারপর এ সুতাকে আমরা এমনভাবে তৈরি করি যেন এই দড়ি দিয়ে আমরা জাহাজও বাঁধতে পারি।'
দ্বিতীয় ধাপে তৈরি হওয়া দড়ির একক অংশকে পাঠানো হয় ফ্লাইয়ারে। ক্রেতার চাহিদামতো রং করা হয় দড়ি। এবার আরেকটি মেশিনে দড়িটির এক অংশ পেঁচিয়ে জোড়া লাগিয়ে মোটা করা শুরু হয়। কতটুকু মোটা হবে তা নির্ভর করে দড়িটি কী কাজ করবে ও ক্রেতার চাহিদার ওপর।
উদ্যোক্তারা জানান, চট্টগ্রাম ইপিজেডে উৎপাদিত এ দড়ির চাহিদা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশে রপ্তানি হয়। জাপান, চীন, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, কানাডা , অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে বাংলাদেশের দড়ি।
বিএমএস রোপের সিনিয়র প্রোডাকশন অফিসার মুজিবুর রহমান বলেন, 'কিছু কিছু পণ্য আমরা জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ইতালিতে রপ্তানি করছি। অন্য দেশগুলোতেও আমাদের দড়ির চাহিদা কীভাবে বাড়ানো যায় আমরা এ বিষয়ে চিন্তা করছি। সারাবিশ্বেই আমরা যেন আরও বেশি রপ্তানি করতে পারি সে চেষ্টা করছি।'
চট্টগ্রামে কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের দড়ি। ছবি: এখন টিভি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বে দড়ির বাজার ছিল ১৩.৬০ বিলিয়ন ডলারের। যা প্রতি বছর ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০৩০ সালে সারা বিশ্বের মানুষ অন্তত ১৮ বিলিয়ন ডলারের দড়ি কিনবে। যার ৪৫ শতাংশ কিনবে এশিয়ার মানুষ।
ইপিজেডের এ কারখানা ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪১ লাখ ৫৫ হাজার ডলার, ২১-২২ অর্থবছরে ৪১ লাখ ১৩ হাজার ডলার ও সবশেষ ২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ লাখ ২২ হাজার ডলারের দড়ি রপ্তানি করে।
বিএমএস রোপের জিএম ইফতেখারুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, 'সারাবিশ্বের এসডিজির সাথে আমাদের রপ্তানির একটা সম্পর্ক আছে। আর আমরা জাপান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা এবং চীনে বিক্রি করছি।'
বিশ্বজুড়ে দড়ির ব্যবহারেও এসেছে পরিবেশ সচেতনতা। কমছে নাইলন বা প্লাস্টিকরে দড়ির চাহিদা, তাই এ কারখানাটিও তার ধরণ পাল্টেছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। এখন নতুন করে রপ্তানির জন্য তৈরি করছে পাটের দড়ি। এছাড়া ব্রাজিল , আফ্রিকা ও কেনিয়া থেকে আমদানি করা এক প্রকার গাছের বাকলকে মিহি করে তৈরি করা হয় শক্ত দড়ি।
ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের স্যাম্পল দেখানোর পর বেপজা থেকে আমাদের বিএমএস কোম্পানি এরইমধ্যে ১০ শতাংশ অনুমতি পেয়েছি। এর জন্য আমরা এখন লোকালভাবেও বিক্রি করতে পারবো। তারা এই দড়ি দেখেই বলেছে যে এই দড়ি তো আমাদের জন্য ভালো। এই দড়ি বেশিদিন ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে জেলেরা বেশিদিন ব্যবহার করতে পারবে।'
গবেষণা বলছে, বিশ্বজুড়ে চাহিদার মোট ৬০ শতাংশ দড়ি ব্যবহার হয় শিল্প কারখানায়, ৩০ শতাংশ বাণিজ্যিক খাতে আর মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার ঘর গৃহস্থালির কাজে।