স্বল্পমূল্য ও মুখরোচক বলে স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবারের জনপ্রিয়তা বেশি। রাজধানীতে প্রতিদিন অর্ধকোটি মানুষ এমন খাবার খেয়ে থাকে। কেউ শখ করে কেউবা সাশ্রয়ী মূল্যে পেয়ে স্বাদ, সাধ্য এবং সময় বাঁচানোর খাতিরেও ভিড় জমান এসব দোকানে।
এসব খাবার তৈরিতে কি তেল ব্যবহার করা হয় সে খবর জানে না অনেকে। খাদ্যে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম উৎস পোড়া ভোজ্য তেল। যা বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ও হোটেল রেস্তোরাঁতে ভাজা-পোড়ার পর উৎপন্ন হয়।
দেশে এমন ক্ষতিকর তেলের উৎপাদন হলেও ব্যবস্থাপনা হচ্ছে খুবই নগন্য। এই তেলের অধিকাংশই নানাভাবে ছোট ছোট হোটেল রেস্তোরাঁ বা ফুটপাতের খাদ্যের দোকানে পুনরায় ব্যবহার হচ্ছে বা ফেলে দেয়া হচ্ছে ড্রেন অথবা ডোবা-নালায়।
দোকানিরা বলেন, 'কাজ শেষে তেল ড্রেনে ফেলে দেই। আবার অনেকসময় ছেকেঁ রেখে দেই। পরবর্তীতে ঐ তেল দিয়ে খাবার ভাজি করে থাকি।'
নিরাপদ খাদ্য আইন অনুসারে পোড়া তেলের পুরোটাই ফেলে দিতে হবে অথবা এগুলোকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে যারা বায়ো ফুয়েল তৈরি করে তাদের কাছে দিয়ে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মেহরীন যারিন তাসনিম বলেন, 'পোড়া তেল বারবার ব্যবহার করলে তেলের পোলার কম্পাইন্ড বেড়ে যায়।'
পোড়া তেল আবারো ব্যবহারে নিরাপদ খাদ্য যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। ফলে হতে পারে ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো জটিল রোগ।
বিএসএমএমইউ এর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী জানান, 'পোড়া তেলে হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, উচ্চ কোলেস্টেরল এর জন্য স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং শরীরে আরও যে রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো বেড়ে যায়। একবার ব্যবহার করার পর সে তেল দিয়ে পুনরায় রান্না করা যাবে না কখনও।'
পোড়া ভোজ্য তেল ফেলে দিলে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি দ্বিতীয়বার ব্যবহারে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। অন্যদিকে আমাদের দেশের ফেলে দেওয়া তেলকে দ্বিতীয়বার রুপান্তর করা হয় বায়োডিজেলে। যেটি যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয় ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ায়। যেখান থেকে বাংলাদেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা।
দেশে বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রতি মাসে প্রায় ১ হাজার টন পোড়া ভোজ্য তেল জমে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় অস্ট্রিয়াভিত্তিক বায়োডিজেল প্রস্তুতকারী কোম্পানি মুয়েঞ্জার বাংলা প্রাইভেট লিমিটেড রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে পোড়া তেল সংগ্রহ করে। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার হোটেল রেস্তোরাঁ হতে প্রতিমাসে সংগ্রহ করা প্রায় ১০০ টন পোড়া তেল অস্ট্রিয়াতে রপ্তানি করে তারা।
প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি ও বড় রেস্তোরাঁগুলোতে পোড়া তেল সংগ্রহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এসব প্রতিষ্ঠান তেল জমিয়ে রাখে যা নির্দিষ্ট সময় পর পর সংগ্রহ করা হয়। প্রতি লিটার পোড়া তেল ৫৫-৬০ টাকা দরে বিক্রি করে রেস্তোরাঁগুলো।
এক রেস্তোরাঁ মালিক জুবায়ের মোকাররম হোসেন জানান, 'পোড়া তেল মানুষের স্বাস্থের জন্য খুব ক্ষতিকর, পোড়া তেল আমার ক্রেতাদের আমি দিব না। সেজন্য মুয়েঞ্জারের কাছে বিক্রি করে দেই। এখন লিটারপ্রতি ৫৫ টাকা করে বিক্রি করছি এ তেল।'
২০২০ সাল থেকে শুধু খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ও হোটেল রেস্তোরাঁর পোড়া তেল সংগ্রহ করলেও এখন বাসা বাড়ি থেকেও সংগ্রহ করছেন তারা। বিনিময়ে মাস শেষে উপহার পাবেন তেল প্রদানকারীরা। সম্প্রতি এমন একটি উদ্যোগ শুরু হয়েছে রাজধানীর মগবাজারের ওয়েসিসের কলোনিতে।
এতে অংশ নেয়াদের একজন সেখানকার বাসিন্দা সামান্তা ইসলাম। আগে রান্না শেষে দ্বিতীয়বার তেল ব্যবহার করলেও এখন তিনি বোতলে সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট জারে।
সামান্তা ইসলাম বলেন,'আগে আমি রান্না করার পর বেঁচে যাওয়া তেল আবার রান্না করতাম বা ফেলে দিতাম। এখন আমি তেল সংগ্রহ করে কন্টেইনারে করে মুয়েঞ্জার কাছে দিয়ে দেই।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ার অন্যতম কারণ শিল্পোন্নত দেশগুলোর কয়লা ও ডিজেলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর। তবে প্রাকৃতিক ডিজেলের পরিবর্তে বায়োডিজেলে গাড়ি চালালে কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'ভোজ্য তেল বায়োডিজেলে রুপান্তর করে যানবাহনে ব্যবহার করা গেলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের হার হ্রাস হবে।'
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সুফি বলেন, 'জ্বালানী সরবরাহ হবে আগামী কিছুদিন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। ব্যবহার করা ভোজ্য তেল পুনরায় রিসাইকেল করে অর্থনৈতিকভাবে জ্বালানী সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।'
শুধু পোড়া ভোজ্য তেল নয়, নানা জাতের তেলবীজ, প্রাণীজ চর্বীসহ সমজাতীয় আরো বিভিন্ন উপাদান থেকে তৈরি হয় বায়োডিজেল। তাই কাঁচামাল রপ্তানি নয়, সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনায় পরিবেশ বান্ধব এই জ্বালানির অর্থনীতি বাংলাদেশকে দিতে পারে নতুন এক সম্ভাবনা।