২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বীন মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি জমি বিক্রি করা ৮৭ লাখ টাকা জমা করেন নিজ এলাকা মানিকদি শাখার ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে। পরে ৫০ হাজার ও এক লাখ টাকা করে কিছু টাকা উঠালেও হঠাৎ একদিন দেখেন সেই হিসাবে টাকা নেই।
সার্ভার সমস্যার কথা বলে একাধিকবার তার আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হলেও জানেন না আসল সমস্যা কোথায়। খোঁজ নিয়ে দেখেন তার ভাতিজা ও এজেন্ট মালিকই আত্মসাৎ করেছে দ্বীন মোহাম্মদের অর্থ।
দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, 'মাঝে মাঝে এসে বলতো যে কাকা, আপনি একটু ব্যাংকে যাইয়েন তো। আমি কারণ জানতে চাইলে বলতো সার্ভারে অসুবিধা।'
ভুক্তভোগী
ভুক্তভোগীর ভাতিজা ৪৪ লাখ টাকা সরিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করে এবং বিষয়টি মিমাংসা হয়। তবে এজেন্ট মালিক আতিকুল ইসলামের কাছে একাধিকবার লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হলে দেন ভুয়া কাগজপত্র। পরে মূল শাখা থেকে সেই তথ্য সংগ্রহ করেন দ্বীন মোহাম্মদ। দেখেন এজেন্ট মালিক তার স্ত্রী হিসাবে নিয়েছেন ১০ লাখ টাকা । সেই সাথে শুরুতে দেয়া ২০ লাখ ও পরে দেয়া সাত লাখ টাকা করেননি জমা।
দ্বীন মোহাম্মদের মেয়ে দিল আফরোজ বলেন, 'কাওরান বাজার মোড় ব্রাঞ্চ থেকে একটা স্টেটমেন্ট উঠিয়ে দেখি দুইটি লেনদেনের মাঝে ট্রান্সফার হয়েছে ১০ লাখ টাকা। তখন জানতে পারি এই অ্যাকাউন্ট হচ্ছে ক্যাশিয়ার সানজিদার।'
শুধু টাকা নিয়েই থেমে থাকেননি। ভুক্তভোগী টাকার জন্য চাপ দিলে দ্বীন মোহাম্মদসহ পরিবারের বিরুদ্ধে দেন ডাকাতি মামলা। এছাড়া আওয়ামী সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ে নানা হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীর মেয়ে জামাই সৈয়দ রায়হান উদ্দিন বলেন, 'আমরা কোনোদিকে ওর সাথে কথাবার্তা বলতে পারি না। এমনকি রাজনৈতিকভাবে আমাদের খুব চাপের মধ্যে রেখেছে। আমাদের মামলা দিয়েছে। মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করছে। এখন আমরা হয়রানির শিকার হয়ে হাজিরা দিচ্ছি।'
এদিকে জমা করা ২০ লাখ টাকার মধ্যে ১৫ লাখ নেয়ার কথা প্রথমে স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করেন তিনি।
এছাড়া আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনায় নানা অভিযোগ। সালমা আক্তার নামে ব্যাংকের নিয়োগ প্রাপ্ত না এমন নারীকে বানিয়েছেন শাখা ব্যবস্থাপক।
সালমা আক্তার বলেন,' আমি ব্যাংকের কেউ না। ব্যাংকের কিছু না আমি। আমাকে উনি মামী ডাকে। শুধু উনার ব্যাংক কয়দিন বন্ধ ছিল সেজন্য আমাকে বলেছিল আমাকে কয়দিন বসতে। আমাকে ম্যানেজার বানিয়ে কার্ড ছাপিয়েছে। হেড অফিস তদন্ত করতে এসে এটা দেখেছে হেড অফিস।'
এ নিয়ে আতিকুল ও তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেলে তারা এজেন্ট শাখার ভেতরে থাকলেও কথা বলেননি।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক এশিয়ার প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন দ্বীন মোহাম্মদ ও তার পরিবার। পরে তদন্তের মাধ্যমে আতিকুল ইসলামের জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও তিন বছর এই সমস্যার এখনও সমাধান করা হয়নি।
আতিকুল ইসলামের মালিকানায় থাকা চারটি এজেন্ট শাখায় যেসব অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে তার দায় স্বীকার করেছে ব্যাংক এশিয়া। এখন পর্যন্ত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ফেরত দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, '২৫ বা ৩০ শতাংশ অর্থ রিকভার হয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার কাস্টমার বলে না শুধু সে একজন ব্যক্তি হিসেবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিবো।'
এদিকে আতিকুল ইসলামসহ ব্যাংক এশিয়ার ১৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ৩০ দিন সময় দিয়ে লিগাল নোটিশ দিয়েছেন দ্বীন মোহাম্মদ।
দ্বীন মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন বলেন, 'এই টাকা পয়সা যে আত্মসাৎ করেছে, প্রতারণা করেছে এটা ব্যাপারে কোনো অবস্থায় যদি প্রতিবাদ করে তাহলে একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। তাদের হ্যারেজমেন্ট করার কারণেই মূলত এই একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের আসামি করছে।'
আতিকুল ইসলামের এ ধরনের কার্যক্রমকে প্রতারণা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে টাকা ফেরত দেয়া ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যাংক এশিয়াকেই ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসেন আরা শিখা বলেন, 'এটা তো পুরোপুরি জালিয়াতি। ফ্রড বা জালিয়াতি হলে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেটা আলাদা। কিন্তু কোনো গ্রাহক যদি কোনো এজেন্টের দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকেন তাহলে সেই গ্রাহকের প্রতারণার বিরুদ্ধে যে ক্ষতি সেই ক্ষতি কিন্তু ব্যাংকেই দেখতে হবে। এখানে কোনোমতে ব্যাংকের দায় এড়াবার সুযোগ নেই।'
ব্যাংকের এজেন্ট সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না করলেও অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।