ব্যাংকপাড়া
অর্থনীতি
0

ক্ষুদ্র ঋণে বেকারত্ব দূর-স্বনির্ভরতা বাড়ালেও প্রয়োজন সরকারের নীতি সহায়তা

দেশের ব্যাংক যেখানে হোঁচট খাচ্ছে, সেখানে তৃণমূলের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ আমানতকারীর নিয়মিত সঞ্চয়ে চলেছে মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম। এখন ঋণের হারের তুলনায় বাড়ছে সঞ্চয়ের প্রবণতাও। প্রান্তিকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম কমে বেড়েছে শহর আর শহরতলীতে। তবে মাইক্রোক্রেডিটে বেকারত্ব দূর ও স্বনির্ভরতা বাড়ালেও টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরিতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

চারদিকে বৃষ্টির জল থৈ থৈ করছে। মাঠ ঘাট ফসলের ক্ষেত এখন টৈ টুম্বুর হয়ে আছে পানিতে। আমিষের চাহিদা মেটাতে ক্ষেতের ধারে ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা। কিছু জমিতে আমনের চারা রোপনে ব্যস্ত কৃষকেরা। সারি বেধে রোপণ করা আমনের চারাগুলো কিছুদিন পরে সোনালি ধানে ভরিয়ে ফেলবে কৃষকের গোলা।

দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের প্রায় সব জায়গারই চিত্র একইরকম। কৃষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী। যাদের একসময় কিছুই ছিল না তাদের অনেকেই জমি চাষ করছেন বন্ধক নিয়ে। শুধু জমি বন্ধক নয়, পশু লালনপালন, ছোট ব্যবসা, উদ্যোক্তা এরকম অনেক উদাহরণ তৈরিতে গত প্রায় তিন দশক ধরে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে আসছে দেশের ছোট বড় এনজিও।

এই যেমন পঞ্চগড়ের সিতাগ্রাম এলাকার জলিল বেনু দম্পতি। পেশায় রাজমিস্ত্রি জলিলের ঠিকঠাক থাকার ঘরও ছিল না দুই যুগ আগে। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে থাকার ঘর করেছেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, জমি কিনে বসতবাড়ির আয়তন বাড়িয়েছেন। চাষবাস ফলফলাদি নিয়ে নিজেরাই এখন স্বয়ংসম্পুর্ণ।

বেনু বলেন, 'টিন কিনে আমরা ঘর দিয়েছি। তারপর লোন পরিশোধ করে পরেরবার গরু নিয়েছি। এর পরেরবার মানে এখন লোন নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাই।'

একই গ্রামের এক বাড়িতে দেখা যায় গাছ থেকে বাদাম আলাদা করছেন বেশ কয়েকজন নারী। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এনজিওর ঋণের সাথে জড়িত। তাদের একজন ঋণ নিয়ে স্বামীকে বিদেশেও পাঠিয়েছেন।

স্থানীয় একজন বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছি ৫০ হাজার টাকা। তারপর আইটিএস থেকে নিয়েছি ৫০ হাজার টাকা। আর জমি বিক্রি করি, গরু কিনি, পরে আমার স্বামীকে বিদেশে পাঠাইছি।'

এনজিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখেছেন অনেকে।

স্থানীয় একজন বলেন, 'ঋণ নেয়ার জন্য অনেক টাকা দিতে হয়েছিল। ৫, ১০, ১৫ হাজার টাকা করে নিয়েছিল ঋণ নেয়ার জন্য। দুই, তিন সপ্তাহ ঘোরাঘুরি করার পর টাকা মেরে নিয়ে চলে গেছে।'

ঋণ নিয়ে একদিকে যেমন স্বাবলম্বি হবার গল্প আছে, তেমনি নিঃস্ব হওয়ার দুঃখগাথাও আছে অল্পস্বল্প। জানা গেছে, ৮ থেকে ১০ শতাংশ ঋণ গ্রহিতা এই অর্থ ব্যয় করেন অনুৎপাদন মুলক কাজে।

ক্ষুদ্র ঋণের উদ্যোগ, শাখা সংখ্যা, সদস্য, ঋণ স্থিতি ও সঞ্চয় স্থিতিতে সবচেয়ে পিছিয়ে বান্দরবানও। তবে, এখানকার হিসেবটা কিছুটা ভিন্ন। এখানে চ্যালেঞ্জ যেনো পাহাড়ের সাথে ঘেষে ঘেষে চলে।

বান্দরবান প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল আলম সুমন বলেন, 'বান্দরবন জেলায় ক্ষুদ্রঋণ জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে পাহাড়ের দুর্গমতা একটি প্রধান কারণ। এছাড়া আমাদের এখানে ঋণের যে সুদের হার, সেটা মানুষ উচ্চ সুদহার মনে করে। সেজন্য তাদের ক্ষুদ্রঋণের ওপর একটা অনীহা কাজ করে। এরপর কাগজপত্রের জটিলতা আছে। এখানকার মানুষজন যেহেতু শিক্ষাদীক্ষায় একটু পিছিয়ে আছে, এই জটিলতা নিয়ে তাদের ভেতর একটা ভীতি কাজ করে।'

শাখাগুলোর কাজের পরিধি সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে। তবে, সেখানে পরিধি শহার ও উপশহরে সীমাবদ্ধ মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম।

স্থানীয় একজন বলেন, 'আগে বেকার ঘুরে বেরাতাম, এখন ঋণ নিয়ে গাড়ি চালাই। দিনে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কামাই হয়।'

ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা তৈরি হয়েছে দেশে, উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, বেকারত্ব কিছুটা হলেও কমেছে। তবে, আরও গবেষণার প্রয়োজন দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিআইবিএম অধ্যাপক, শাহ্ মো. আহসান হাবিব বলেন, 'যে জায়গায় একটা সমস্যা আছে সেটা হচ্ছে গ্রাজুয়েশন। তারা যখন একটা জায়গা থেকে মাইক্রোইন্টারপ্রাইজে নিজেকে কনভার্ট করবে, এটা একটা সহজ জায়গা নেই। বাংলাদেশের ওই গ্রুপ অব পিপলকে রিয়েলি পুশ করতে চাইলে মাইক্রোক্রেডিট এবং মাইক্রোইন্টারপ্রাইজে জাম্প করার জন্য সাপোর্টের প্রয়োজন আছে। এই সাপোর্টটা সরকারের কাছে থেকে আসতে হবে।'

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির ক্ষুদ্রঋণ শাখার মাধ্যমে এনজিওগুলো ৪.০৮ কোটি গ্রাহককে দুই হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা বিতরণ করেন শুধুমাত্র ২০২৩ সালে। যেখানে সঞ্চয়স্থিতি প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয় ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের কল্যাণে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, 'এমআরএ আর এমএফআই মানুষের জন্য এবং মানুষের টাকাতেই চলছে। এখানে ৭৫ হাজার কোটি টাকা আছে তাদেরই সঞ্চয় করা। প্রান্তিক মানুষের এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে ৭৫ হাজার কোটি টাকা কিন্তু সহজ বিষয় না। আদায়ের হার ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। এবং কোভিডের সময় আদায়ের হার ছিল ৯৩ থেকে ৯৪ শতাংশ। সুতরাং এই ঋণ দেয়া বা নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের যে খরচ, এটা বিবেচনা করেই আমরা সার্ভিস চার্জটা করি। আর এই টোটাল পোর্টফোলিওর ৩৫ শতাংশ হলো মাইক্রোইন্টারপ্রাইজ। আমরা এই এমএফআইকে ডিজিটাল করার জন্য কাজ করছি। এটা ডিজিটাল করা গেলে এখন যে খরচ তার থেকে অনেক কমে যাবে।'

বর্তমান ব্যাংক ও মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় সুদের হারের আবারও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠানটি। যা ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আরো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করবে বলে মনে করে সংস্থাটি।

tech

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর