হেমন্তের মধ্যদুপুর। কাজে কিছুক্ষণের ফুরসত মিলেছে তেজগাঁওয়ের কলোনী বাজারের দলিল লেখক মাইনুদ্দিনের চেম্বারে। ততক্ষণে বাসা থেকে টিফিন বক্স ভর্তি খাবার পৌঁছে গেছে। একে একে সবার পাতে উঠলো খাবার। মনে তৃপ্তির ঢেঁকুর।
পোশাক কারখানার বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা দিদার হোসেনের নিবাস সাভারে হলেও কর্মস্থল রাজধানীতে। প্রতিদিন বাসা থেকে খাবার আনা সম্ভব হয় না, তাই দুপুরের খাবার সেরে নেন রেস্তোরাঁয়। জানালেন, খাবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে সংসারের অন্যান্য খরচে।
তিনি বলেন, 'আমরা যারা বাইরে খাই তাদের একটু হিসেব করে চলতে হয়। কারণ দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।'
গত কয়েকবছরে বাজারে ডিম, মুরগি, তেল, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবারের খরচ। নিয়মিত যারা রেস্তোরাঁয় খান, তারা খাবার মেন্যুতে এনেছেন পরিবর্তন। মাছ, মাংসের মতো আমিষের পরিবর্তে প্লেটে তুলছেন সবজি, ভর্তা আর ডাল।
তারা বলেন, মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় ভর্তা-ভাজি দিয়ে খেতে হচ্ছে। ১৫ টাকার ভর্তাও এখন ২৫-৩০ টাকা দিয়ে খেতে হয়। কমপক্ষে ২০ শতাংশ খাবার খরচ বেড়েছে।
খরচ সমন্বয়ে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন অটোরিকশা চালক সুমনের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এক বছর আগের তুলনায় ভাত ও সবজির দাম প্লেটপ্রতি বেড়েছে ৫ টাকা, ডিমের আইটেমে ১০ টাকা এবং ১৫-২০ টাকা বেড়েছে মুরগি বা মাছের দাম। অর্থাৎ একবেলার খাবারের মেন্যুতে খরচ বেড়েছে অন্তত ৩০ টাকা।
চালক সুমন বলেন, 'আগে ৫০ টাকায় ভাত-মাছ খেতে পারতাম। আর এখন লাগে ১০০-১২০ টাকা। মাংস খেতে ইচ্ছে করলেও ৬ মাসে একবার খেতে পারি না।'
রাজধানীর কয়েকটি এলাকার হোটেল-রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেল, গরুর মাংসের কোন পদ রান্না করেন না তারা। মাংসের দাম বাড়াকেই দায়ী করেছেন তারা।
রেস্তোরাঁ মালিকরা জানান, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খাবারের খরচে লাগাম টানছেন অনেকে। এতে ক্রেতা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। আগে ১২ টায় দুপুরের খাবার বিক্রি শুরু হতো, এখন ২টা বাজলেও ক্রেতার দেখা নেই।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সারাদেশে ৪ লাখ ৩৬ হাজার হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত ২০ লাখের বেশি জনবল। তবে ক্রেতা খরায় একের পর এক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ায় উদ্বিগ্ন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, 'নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা খরচ কমিয়ে দিয়েছে। আমাদেরকে টিসিবির পণ্যসহ ট্যাক্সের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলে ভালো হতো।'
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান এখন টিভিকে বলেন, 'ভোক্তা যদি ব্যয় সংকোচন করে তাহলে এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।'
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সারাবিশ্বেই বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। এসময় দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামে লাগাম টানতে না পারলে খাদ্যে মতো মৌলিক চাহিদা পূরণও কঠিন হয়ে পড়বে অনেকের জন্য। সংকট উত্তরণে পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজার নজরদারিতে আরও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।