১৯ বছরে হয়নি লগি-বৈঠা হামলার বিচার; রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের হামলার কিছু মুহূর্ত | ছবি: সংগৃহীত
0

১৯ বছরেও বিচার হয়নি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠা হামলার। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক বিচারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। আগামীর নির্বাচিত সরকারকে এই দায়িত্ব নেয়ার তাগিদ তাদের।

২৮ অক্টোবরের রক্তাক্ত বিকেল। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যাও সেদিন উল্লাসের উপলক্ষ করার অভিযোগ আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে।

২০০৬ সালের অক্টোবরে, বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেয়া ঠেকাতে মাঠে ১৪ দলীয় জোট।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ডাকে ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা রাস্তায় নামে তার কর্মীরা। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা হরা হয় জামায়াত-শিবিরের ৬ নেতাকর্মীকে।

এমনকি মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহের ওপর নৃত্য করার নারকীয়তারও স্বাক্ষী হয় গোটা দেশ! নিন্দার ঝড় উঠেছিল দেশে-বিদেশে।

সেদিন দুপুরে বাইতুল মোকাররম মসজিদের পাশেই শহিদ হন ঢাকা কলেজের ছাত্র ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী গোলাম কিবরিয়া শিপন। ২৮ অক্টোবর অনেকে ভুলে গেলেও ছোট ছেলেকে হারানোর ব্যাথায় এখনো কেঁপে উঠে বাবার বুক। বলছিলেন, তার আদরের সন্তানের সবগুলো দাঁত তুলে নেয়া হয়েছিল।

শুধু শিপন নয় সারা দেশে বিভিন্ন বয়সের ১৩ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তিন দিনের অশান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বালাও-পোড়াও ও হত্যা-নৈরাজ্য ছড়িয়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ২৮ অক্টোবর, ক্ষতি হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকার। জামায়াতের পক্ষ থেকে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করা হলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে, মামলা প্রত্যাহার করা হয়।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবারো শিউরে উঠলেন তৎকালীন শিবির সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। পিটিয়ে এমন হত্যাযজ্ঞের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান তিনি।

আরও পড়ুন:

তৎকালীন শিবির সভাপতি ও বর্তমান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘পুরো ১২ ঘণ্টা সময় আমার চোখের সামনে ছিল। আমি দেখেছি যে আমার ভাইয়েরা জীবন বাজি রেখেছেন, কিন্তু ১ সেকেন্ডের জন্যও তারা পিছপা হননি। সন্ধ্যা ৭টায় প্রশাসন যখন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা আমাদের অফিসে ফিরে আসছি।’

দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না আনতে পারলে শত সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে সহনশীলতা আনতে হবে। এছাড়া শান্তিপূর্ণ মনোভাব রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বানও জানান তিনি।

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে না পারলে, শত সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। আমাদের মধ্যে সহনশীলতা থাকতে হবে, অন্যের প্রতি দ্বিমত পোষণ করেও তার প্রতি সম্মান জানাতে হবে, তার মতের প্রতি সম্মান জানাতে হবে এবং বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে।’

রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দূষিত করার মতো ঘটনার বিচারের পরামর্শ দেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ভবিষ্যতে সরকার এমন ঘটনাগুলোর বিচার নিশ্চিত না করলে আবারও স্বৈরাচার ফিরে আসার শঙ্কা রয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভবিষ্যত সরকার বা এ সরকারও যদি পারে, তাদের উচিত এসব বিষয়ে মনোযোগ দেয়া। যেসব ঘটনাগুলো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দূষিত করেছে অথবা বর্বতার সাক্ষী হয়েছে অথবা যেসব কাজগুলোতে দেশের রাজনীতি ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে—তার মূলোৎপাটন করার দরকার আছে। সরকারের সেই উদ্যোগ নেয়া জরুরি।’

২০০৬ এর মত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরেও, বিএনপি জামায়াতের সমাবেশে হামলায় একই অভিযুক্ত-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সঙ্গে পুলিশ বাহিনী। আগের মত এই ঘটনাও রয়ে গেছে বিচারের বাইরে। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে আগামী নির্বাচিত সরকারের প্রতি আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।

এসএইচ