বিশেষ প্রতিবেদন
দেশে এখন
0

বিজয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়

১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে বিজয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে ২০০ এরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। জাতিকে মেধাশূন্য করতে এ হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন ও জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে যারা অবদান রেখেছিলেন, ২৫ মার্চের পর থেকেই তারা পরিণত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্যে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই ১৯৭১ এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২৪ এও।

প্রিয় বাংলাদেশ, দেয়ালবন্দি ঘরে তোমায় ঠিক বোঝা যায় না। তোমায় বুঝতে রাজপথ লাগে। তোমায় কতটা ভালোবাসি তা টের পেয়েছিলাম ২৪ এর জুলাইয়ে। যেমন ৭১ এ তোমায় ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছিল আমার পূর্বপুরুষরা।

লাল-সবুজের পতাকা দেশের শক্তি, সাহসের প্রতীক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর দেশের সাহসী তরুণরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যার যা আছে, তাই নিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পাকিস্তানিরা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিঃশেষ করায় মনোযোগ দেয়। হত্যা করা হয় দেশের এক হাজারের বেশি শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, প্রকৌশলীসহ মুক্তচিন্তার ও সমাজের অগ্রসর মানুষদের। তবে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে শেষ সময়ে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, প্রকৌশলী ১৬ জন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, 'তারা যেটা চেয়েছে সেটা হলো বাংলাদেশে যেন একটা চিন্তাশূন্য অবস্থা তৈরি হয়। এত বছর পরও তারা কী কারণে, কীভাবে হত্যা করেছে এই ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য কিন্তু আমাদের হাতে নেই।'

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ কায়সারকেও একইভাবে তুলে নেয়া হয়। এদিন সর্বোচ্চ ২০০ জন বুদ্ধিজীবীকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, 'উনাকে নিয়ে যাওয়ার সময়টা আমার মনে আছে। ছোট কাকার বাড়ি থেকে উনাকে অপহরণ করা হয়েছিল। বাংলায় কথা বলছিল ছেলেগুলো, মুখ ঢাকা ছিল এবং স্যার বলে সম্বোধন করছিল বলে মনে পড়ে আবছাভাবে। উনি যে মাপের একজন শিক্ষক ছিলেন, শিক্ষাবিদ ছিলেন, পণ্ডিত ছিলেন সেই পরিবেশ তো আমরা আর পেলাম না।'

তবে এত ত্যাগের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেই দেশেও ফিরে ফিরে এসেছে অত্যাচার নিপীড়নের দাহকাল। গুম-খুন-নৃশংসতায় পোক্ত করার চেষ্টা হয়েছে ক্ষমতার মসনদ। নিপীড়ন থেকে বাদ যাননি মুক্তচিন্তার মানুষগুলো। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে গুম হওয়ার ঘটনাও রয়েছে দেশের বুদ্ধিজীবীদের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, 'স্বাধীনতার আগে এই যে ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের গুম করে ফেলা। সে কারণে আমিও টার্গেট ছিলাম। আমি যে কারণে হামলার শিকার হয়েছি তার অনেকগুলো কারণ ছিল। ধরেন আপনি বলছেন বাংলাদেশের সংবিধান হলো পবিত্র সংবিধান আর আমি বলছি ৭২ এর সংবিধান পাকিস্তানের সংবিধান। সে কারণে স্বভাবতই আমি টার্গেট ছিলাম।'

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ইয়াহিয়ার পথই হেঁটেছিল বিগত শেখ হাসিনা সরকার, যার সাক্ষ্য দিচ্ছে বন্দিশালা 'আয়না ঘর'।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, 'বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করে দেয়া গেলে মেরে ফেলে দেয়া হলে, একেবারে নিশ্চিহ্ন করা গেলে সে জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে। সে চিন্তাভাবনা থেকেই ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের একভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২৪ এর কথাও বলা যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চেতনার জায়গাগুলো যদি আমার পছন্দ না হয়, আমার দলের পছন্দ না হয় তাহলেই তাকে দমিয়ে দেয়া হয়।'

এই সময়ের বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিস্টরা বারবার মুক্তচিন্তাকে আঘাতের চেষ্টা করলেও তা যে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হয়, তারই প্রমাণ ৭১ আর ২৪ এর বিজয়।

এসএস