তেল আবিব–ওয়াশিংটন সখ্যতা বেশ পুরনো। ১৯৫৯ সাল থেকে ইসরাইলকে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত গেলো বছর আর চলতি বছরে তেল আবিবকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে ওয়াশিংটন। এখন পর্যন্ত সেই সহযোগিতার পরিমাণ ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। যদিও এতে ইসরাইলের তুলনায় লাভবান হচ্ছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি'স ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের কস্টস অব ওয়ার প্রকল্পের গবেষণা বলছে, ইসরাইলকে ওয়াশিংটন যে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে, সেই অর্থ ঘুরে ফিরে চলে আসছে ওয়াশিংটনেই। কারণ ইসরাইল অস্ত্র কিনছে মার্কিন সামরিক প্রতিষ্ঠান থেকে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠাগুলোর ব্যবসা যেমন স্থিতিশীল রয়েছে, তেমনি বাড়ছে কর্মসংস্থান।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি সামরিক সহায়তা প্রকল্পগুলোতে শর্তই থাকে বেশিরভাগ সমরাস্ত্র মার্কিন প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে নেয়ার। দীর্ঘমেয়াদি এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই থাকে সব বিতর্ক। ইসরাইল এমন এক ভূখণ্ড যেটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি অস্ত্র কিনতে পারে। ন্যূনতম থাকে জবাবদিহিতা।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির বাজার চাঙা করতে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই ইসরাইলের জন্য সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। বিক্রি হওয়া অস্ত্রের স্থান পূরণ করতে আরও কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৫ সালের বাজেটে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি ৯ হাজার ২০০ কোটি ডলারের তহবিল রেখেছে হোয়াইট হাউজ, যেখানে রয়েছে প্রয়োজনে ইসরাইলকে সহযোগিতা করার বিষয়টি। এর মধ্য দিয়ে নতুন চাকরি সৃষ্টির পাশাপাশি স্থিতিশীল হবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের চাকরির বাজার।
নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিকভাবেও প্রভাব ফেলছে ইসরাইলকে অবাধে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি। ডেমোক্রেটরা এখনও এই ইস্যুতে রিপাবলিকানদের চাপে রয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় বড় কোম্পানি বোয়িং, জেনারেল ডায়নামিক্স, লকহেড মার্টিন, নর্থরোপ গ্রুম্যান, আরটিএক্স আর ক্যাটারপিলার।
এই কোম্পানিগুলো অন্যান্য সরবরাহকারী আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ইসরাইলের সঙ্গে বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ইসরাইল পরিণত হয়েছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকে।
আরটিএক্স বৃহত্তম গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। লঞ্চপ্যাড থেকে ছোড়ার পর এই ক্ষেপণাস্ত্র গতিবিধিতে পরিবর্তন আনতে পারে। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, এই কোম্পানি ইসরাইলকে এফ সিক্সটিন ও এফ ফিফটিন যুদ্ধবিমানের জন্য আকাশ থেকে মাটিতে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আর ইঞ্জিন দিয়েছে। এই কোম্পানি ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের জন্য ইন্টারসেপ্টর তৈরি করছে। আকর্ষণীয় সব চুক্তির জন্য আরটিএক্স'এর বাজারমূল্য বছর ব্যবধানে ৮৪ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লকহেড মার্টিন তেল আবিবকে দিচ্ছে যুদ্ধবিমান এফ থার্টি ফাইভ ও এফ সিক্সটিন। যা দিয়ে গাজায় বোমা ফেলছে তেল আবিব। গেলো বছর স্থল অভিযান শুরুর সময় এই প্রতিষ্ঠানের হারকিউলিস হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। ইসরাইলের অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের জন্য হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে লকহেড মার্টিন। যুদ্ধ শুরুর প্রথম মাসে তেল আবিবকে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে এই কোম্পানি। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং তৈরি করছে এফ সিক্সটিন ফাইটার জেট আর অ্যাপাচি এ এইচ সিক্স ফোর হেলিকপ্টার, যা দিয়ে গাজা লেবাননে সমানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে আইডিএফ। রাফায় যে শক্তিশালী ২৫০ পাউন্ডের বোমা ইসরাইল ফেলেছিলো, সেটি বোয়িংয়ের তৈরি। গেলো কয়েকবছরে বিমানে নানা ত্রুটি ও দুর্ঘটনার কারণে যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমানের বাজারে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে গেছে বোয়িং। কিন্তু প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও মহাকাশ খাতে অবস্থান হয়েছে বেশ চাঙা। বোম্বার, হেলিকপ্টার আর বৈদ্যুতিক গোয়েন্দা যন্ত্রাংশ তৈরি করে বোয়িংয়ের অস্ত্র ব্যবসা এখন তুঙ্গে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল ডায়নামিক্সও ফুলে ফেঁপে উঠেছে অস্ত্র বিক্রি করে। এটি মার্কিন একমাত্র কোম্পানি, যেটি এমকে-এইটি বোমার জন্য লোহার আবরণ তৈরি করে। এই বোমা দিয়েও গাজায় হামলা করেছে ইসরাইল। এই বোমার বড় সিরিজ, দুই হাজার পাউন্ডের বোমা, যেটির ১০০ ফিটের মধ্যে থাকা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে, এমন পাঁচ শতাধিক বোমা গাজায় যুদ্ধের প্রথম মাসেই ফেলেছিলো ইসরাইল। এই প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্যও বছর ব্যবধানে ৩৭ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নর্থরোপ গ্রুম্যান ইসরাইলের কাছে বিক্রি করেছে অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা, একইসঙ্গে যুদ্ধবিমানের জন্য অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা। গাজায় আগ্রাসনে ইসরাইলি নৌবাহিনীর ব্যবহৃত পাঁচটি সার রণতরীও এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি। সেই থেকে এই কোম্পানির বাজারমূল্য ২৮ শতাংশ বেড়েছে। মার্কিন আরেক কোম্পানি ক্যাটারপিলারের বুলডোজার ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দিয়েছে আইডিএফ। এই প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য বেড়েছে ৫২ শতাংশ।