পর্যাপ্ত খাবার-পানি না দিয়ে, হাঁটু গেড়ে বসতে কিংবা হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হতো সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি সাধারণ মানুষকে। নিজেদের মধ্যে সংঘাত বাঁধাতে সাপসহ বিষাক্ত পোকামাকড় ছেড়ে নির্যাতন করা হতো তাদের। অনেক সময় বাঁশ, লোহার রড, চামড়ার বেল্ট, রাইফেলের বাট এমনকি বৈদ্যুতিক তার কিংবা মোটরসাইকেলের চেইন দিয়েও মারা হতো তাদের।
সেনাবাহিনীর হাতে নিপীড়নের শিকার, এমন বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে এভাবেই মিয়ানমার জান্তার নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন দেশটিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান জেমস রোডহেভার। বলেন, দেশের শাসনব্যবস্থা কুক্ষিগত করে রাখতে সংকটকে পুঁজি করে সব ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।
জাতিসংঘের মিয়ানমার মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন প্রধান জেমস রোডহেভার বলেন, 'কী হয়েছে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? দীর্ঘসময় ভয়ংকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল তাদের। চরম নির্যাতন করা হতো, ভুল চিকিৎসা দেয়া হতো। অনেক মারধর করা হতো। শ্বাসরোধ, উপহাস করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া, বিদ্যুতের শক দেয়া, লাইটার, সিগারেট আর গরম পানি দিয়ে টর্চার করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেনাবাহিনী ভয়ংকর সব উপায় খুঁজে বের করেছিল বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালাতে।'
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনারের কার্যালয় বলছে, সেনা শাসন বিরোধী ও জাতিগত এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রাণ গেছে প্রায় আড়াই হাজার বেসামরিক নাগরিকের। শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে বিমান আর আর্টিলারি হামলায়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭ হাজারের বেশি মানুষ। এরমধ্যে বাবা মা খুঁজে না পাওয়ায় যেসব শিশুদের তুলে নেয়া হয়েছে, তারা আর পরিবারের কাছে ফিরতে পারেনি। নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা, ভুল চিকিৎসাসহ নানা কারণে এদের মৃত্যু হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল বলেন, '২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সামরিক সংঘাতে অনেক নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে। হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে। এদের মধ্যে ১ হাজার ৮শ' এরও বেশি মানুষ বন্দিদশায় মারা গেছেন। নারী ও শিশুও ছিল। বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনের কারণে। অনেকে আবার চিকিৎসার অভাবেও মারা গেছে।'
যদিও এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো মন্তব্য করেনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন এসিস্টেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স জানায়, সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারের এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়া উচিত। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও গণহত্যা নিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে।
২০২১ সাল থেকে দেশটিতে সংঘাত সহিংসতা পৌঁছেছে চরমে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই, দেশটির সীমান্ত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত বেড়েই চলেছে।