দেশে এখন
0

মণপ্রতি ৮ কেজি বেশি; ব্যাপারী ঠকাচ্ছেন কৃষকদের

রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে আম বেচাকেনায় প্রতিনিয়ত ঠকছেন কৃষক। আম বেচাকেনায় মানা হচ্ছে না ওজন ও পরিমাপের সঠিক মানদণ্ড। ঢলন পদ্ধতির চল থাকায় কৃষকের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত আম এক প্রকার লুটে নিচ্ছে ব্যাপারি ও আড়তদাররা। এমন বেচাকেনাকে রীতিমতো প্রতারণা বলছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

মাঘ থেকে শুরু হয়ে আম বাগানের যত্ন চলে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত। জাতভেদে প্রতিমণ ফলের উৎপাদন ও বাজারজাত পর্যন্ত কৃষকের খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রকৃতভাবে বাজারে কতটা মূল্য পাচ্ছে কৃষক?

একজন আম বিক্রেতা কৃষক বলেন, 'গাছে মুকুল আশা থেকে শুরু করে ছয় ধাপে খরচ হয়। আম গাছ থেকে পাড়তে অনেক ব্যয় হয় আমাদের। শুধু গাছ থেকে পারলেই তো হয় না। এর সাথে গাড়িভাড়া, সার, আমের যত্ন নেয়ার জন্য লোক রাখা। সবকিছু মিলে আমরা লসে আছি।'

প্রায় ২৬ একর জায়গা জুড়ে বানেশ্বর বাজার। যার এক কোনে বসে এ অঞ্চলের আমের সবচেয়ে বড় পাইকারি হাট। রাজশাহীর পুঠিয়া, দূর্গাপুর, চারঘাট-বাঘাসহ নয় উপজেলা এবং নাটোর ও নওগাঁর কিছু গ্রাম থেকে আম আসে এই হাটে। এখানে আসা আমের মানের ভিত্তিতে ঠিকা ও ওজন পদ্ধতিতে চলে দর কষাকষি। কিনে নেয়া আমের গায়ে দর ও ক্যারেট সংখ্যা লিখে নিজ নিজ আড়তে পাঠিয়ে দেন ব্যপারী।

কৃষকের ভ্যানেই হাট থেকে আম পৌঁছায় আড়তে। এক মণ ৪০ কেজিতে হলেও সেখানে ৪৮ কেজিতে মণ হিসেবে মাপা হয় আম, এখানেই কৃষকের বাড়তি যায় ৮ কেজি। সাথে যোগ হয় আড়তের কর বাবদ প্রতি দুই ক্যারেটে ৩ কেজি। এখানেই শেষ নয়, দাঁড়িপাল্লায় মাপ নেয়ার দরুন আরও দুই কেজি আম অতিরিক্ত নেয় ব্যাপারীরা। তাতে এক মণ আম বিক্রি করতে, কৃষককে অতিরিক্ত ১৫ কেজি আম দিতে হয় বিনামূল্যে। আমের জাত ভেদে যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৭৫০ টাকা থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক।

এতজন কৃষক বলেন, 'এমনিতেই ৪৮ কেজিতে মণ হিসাব করছে। আবার একটা ক্যারেটের ওজন হয় দেড় কেজি, সেখানে তিন কেজি বেশি নিচ্ছে। আমরা ৪ কেজি আমের দাম পাই ৫০ বা ৫২ কেজিতে।'

আমের বেচাকেনায় অতিরিক্ত আম নেয়া যেন এ বাজারে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন কাঁচামালের পচন, পাকলে কমে যাওয়ার দরুন অতিরিক্ত আম নিচ্ছেন তারা।

একজন আড়তদার বলেন, '৪৮ কেজির সাথে ক্যারেট ২ কেজি নিয়ে ৫০ কেজি নিয়ে নেই আমরা। এই ৪৮ কেজির মধ্যেই দুই কেজি শলা থাকে। প্রথমে আম কাঁচা ওজন করি। এরপর ক্যারেটের ওজন বাদ দেই।'

হিসাব বলছে, কৃষকের থেকে পাওয়া অতিরিক্ত আমের মূল্য দিয়েই পরিবহন খরচ মিটে যায় ব্যবসায়ীর। তবুও রাজশাহী বা ঢাকার খুচরা বাজারে আমের দাম কমে না। যাকে রীতিমতো প্রতারণা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর, অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অন্যান্য ফসলের মতো আমের বেচাকেনাতেও সিন্ডিকেটের বলয়ে পড়েছে চাষি।

রাজশাহীর নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নাসরিন লুবনা বলেন, 'সরকার যেটা নির্ধারণ করবে, সারাদেশেই সেটা চলবে। এজন বা পরিমাপের সমতা নিশ্চিতের জন্য একইভাবে চলবে। কিন্তু রাজশাহীতে কোথাও আমের মণ ৪৫ কেজিতে আবার কোথাও ৪৮ কেজিতে।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদ উদ্দীন খাঁন বলেন, 'কৃষকদের বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে এসেই বিক্রি করতে হয়। এক্ষেত্রে আড়তদাররা একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে। তারা নানাভাবে কৃষকদের ঠকানোর চেষ্টা করে।'

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে সচেতন করার চেষ্টা করছেন তারা।

রাজশাহী জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ইব্রাহীম হোসেন বলেন, 'ভোক্তা অধিকার আইনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে পরিমাপে যদি কারচুপি করা হয় সেক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বা এক বছরের জেল দেয়া। আমাদের আইনসম্মত বিধান অনুযায়ী আমরা তাদের সবসময় সচেতন করি।'

চলতি বছর রাজশাহীর ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আম বাণিজ্য বেড়ে সাড়ে ১৫শ' কোটিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা দেখছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এমএসআরএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর