বুড়িগঙ্গার আকাশ তখনও অন্ধকারচ্ছন্ন দেখা মেলেনি সূর্যের। রাতের শেষ ভাগের আঁধার ভেদ করে ক্যামেরার লেন্সে পড়ছিলো দূরের লঞ্চের সার্চ লাইটের ঝলকানি। হয়তো নোঙরের জন্য যুতসই জায়গা খুঁজছে।
এরপর এক এক করে বুড়িগঙ্গার বুকে সদরঘাটে ভিড়তে থাকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে যাত্রী নিয়ে আসা লঞ্চগুলো। এরই মধ্যে শোয়ারিঘাট মসজিদ থেকে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের সুর। আর ঘুম ঘুম চোখে তখন যাত্রীরা লঞ্চ থেকে নেমে ছুটতে থাকেন রোজগারের শহর ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে।
নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, ছাত্র-শিক্ষক, রোগী কিংবা চিকিৎসক সবাই এসেছেন নানা প্রয়োজনে।
যাত্রীদের একজন বলেন, 'গ্রামে কাজ কম তাই ঢাকা আসছি রাজমিস্ত্রি কাজের জন্য।'
আরে একজন বলেন, 'আমার খালু এক্সিডেন্ট করছে ভোলা হাসপাতাল থেকে ফেরত দিয়েছে এইজন্য ঢাকা নিয়ে আসছি।'
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষ যখন নদী পথে কর্মের খোঁজে রাজধানীতে ঢুকছেন, তখন পিছিয়ে নেই উত্তর ও পূর্ব জনপদও। কমলাপুর স্টেশনে ভোর থেকে আসতে থাকে সুবর্ন এক্সপ্রেস, মহানন্দা কিংবা তিস্তা। যেখানে নানা স্বার্থ জড়িয়ে থাকা এই শহরে কেউ ফিরছেন ছুটি শেষে, কেউবা এসেছেন লেখাপড়া শেষে চাকুরির খোঁজে, কেউবা আবার সন্তানকে নিয়ে এসেছেন উচ্চ শিক্ষার জন্য।
ঢাকায় আসা একজন বলেন, 'কোম্পানিগুলোর হেডকোয়াটার ঢাকা। আপনাকে ঢাকায় আসতে হবে।'
আরেকজন বলেন, 'ব্যবসা অর্থনীতি সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রীক হওয়ায় এখানে আসতে হবে।'
শুধু দূরের নগর কিংবা জনপদই নয়, প্রতিদিন নানা কাজে ঢাকায় আসছেন আশপাশের জেলারও হাজারো মানুষ। বিশেষ করে যে কোন কর্মব্যস্ত দিনে গুলিস্তানের হানিফ ফ্লাইওভারের নামার মুখে তাকালেই তা চোখে পড়বে। যানজটের শহরে বাস থামার সাথে সাথেই চাকুরীজীবীদের ছুটে চলা। লাইন ধরে সবাই ছুটছেন যার যার আয় রোজগারের পানে। রোজগারের ঢাকা যেন সবাইকে তাড়া করছে কর্মের দিকে।
নাগরিকদের একজন বলেন, 'আমি একজন সরকারি নার্স। আমারে ট্রেনিং পড়েছে ঢাকা বারডেম হাসপাতালে। আমি বাধ্য হয়েছি ঢাকাতে আসতে। আমি এসেছি কুমিল্লার তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে।'
আরেকজন বলেন, 'নোয়াখালী ভালো চিকিৎস্যা ব্যবস্থা থাকলে আর ঢাকায় আসতে হতো না।'
সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, তিলোত্তমা ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৭শ’ মানুষ আসছেন এবং বছরে ঢাকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন প্রায় ৬ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আসেন দাপ্তরিক কাজ ও চাকরির খোঁজে। মোট পুরুষ আগমনের সাড়ে ২৪ শতাংশই আসেন দাপ্তরিক কাজে। আর চাকরি বা কাজের খোঁজে আসেন প্রায় ২৩ শতাংশ। এছাড়া উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রায় ৮ শতাংশ ও ব্যবসায়িক কাজে সোয়া চার শতাংশ পুরুষ রাজধানীতে আসেন।
আর নারীরা সবচেয়ে বেশী আসেন বিবাহের কারণে। যা মোট নারী আগমনের প্রায় সাড়ে ২৯ শতাংশ। চাকরি বা কাজের খোঁজে ঢাকায় আসছেন সাড়ে ৫ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষায় পৌনে ৫ আর নারীদের মধ্যে দাপ্তরিক কাজে আসছেন ৪ শতাংশ।
এছাড়া বছরে যে পরিমাণ মানুষ শহরের বস্তিতে আসেন, তাদের মধ্যে ৭ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উপ-পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, 'একবার কেউ যদি ঢাকায় আসেন এবং কর্মসংস্থান পেয়ে যান তাহলে দেখা যায় তাদের পরিবারও ধিরে ধিরে আসতে শুরু করে।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে সমন্বিত ব্যবস্থায় উন্নয়ন না হওয়ায় মানুষের শহরমুখীতা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকায় সব কিছুর সদর দফতর রেখে এই প্রবণতা কমানো কঠিন। তারা বলছেন, জেলা পর্যায় পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। আর তা না দিতে পারলে ২০৪০ সালে দেশে প্রতি ২ জনের মধ্যে একজন মানুষ শহরে বসবাস করবে বলে মনে করেন তারা। যার ফলে নগরীর সকল সেবা সংস্থাগুলো তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম, 'সকল কিছুর হেডকোয়াটার করে ফেলেছি ঢাকায় আমরা যে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলি সেটা কিন্তু আসলে হচ্ছে না। যদি এইগুলোতে গ্রাম বা জেলা পর্যায়ে সুপরিকল্পিতভাবে করা যেত তাহলে কিন্তু ঢাকায় আর আসার প্রয়োজন পড়তো না। '
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় তারা আর গ্রামে থাকতে চাচ্ছেন না।’
তাই শহরমুখীতা কমাতে বসবাসের ওপর কর বা হোল্ডিং ট্যাক্স আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিআইডিএস এর তথ্য বলছে, গ্রাম ও পৌর এলাকায় অকৃষি খাতের আয় ১ শতাংশ বাড়লে শহরমুখী মানুষের চাপ কমবে ৪ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত।