অর্থনীতি

কৃত্রিম প্রজননে প্রাণিসম্পদ খাতে নীরব বিপ্লব

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কয়েক বছরে প্রাণিসম্পদ খাতে ঘটেছে নীরব বিপ্লব। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে উন্নত জাতের গরু। মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। কম খরচে বেশি দুধ ও মাংস উৎপাদনসহ এখন সরকারের মনোযোগ এ খাতের মান উন্নয়নে। তবে এক্ষেত্রে পশুর তথ্য সংরক্ষণ জরুরি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

বাঁকানো শিং, লাল-ধুসর রঙ, মাঝারি আকারের আকর্ষণীয় দেশি গরু পাবনা ক্যাটেল। কিংবা রেড চিটাগাং, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম অথবা নর্থ বেঙ্গল, শংকর হয়ে রূপ নিয়েছে উন্নত জাতে। নাম হয়েছে শাহিওয়াল কিংবা হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান ক্রস।

দেড় লিটার দুধের দেশি গাভী, বিদেশি মিশ্রণের পর দুধের গড় পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১০ লিটার। কোন ফ্রিজিয়ান দৈনিক দুধ দেয় ৪০ লিটার পর্যন্ত। মাংস হয় পাঁচশ থেকে হাজার কেজি, কিংবা তারও বেশি।

তবে ইউরোপের শীত প্রধান দেশের এ গরু দেশের উষ্ণ আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারেনা, দেখা দেয় নানা রোগবালাই।

বাংলাদেশে খামার মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, 'দাবদাহের কারণে আমাদের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দুধ উৎপাদন কমে গিয়েছে। ৭ থেকে ৮ মাস বয়সে প্রচুর রোগ বালাই হচ্ছে।'

তাই আবহাওয়া বিবেচনায় দেশি গরুকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ফ্রিজিয়ান বীজ দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা জুয়েনা বলেন, 'অধিক প্রোডাক্টশনের জন্য আমরা গরু নিয়ে আসছি। আমাদের দেশে উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না এই জলবায়ুর কারণে।'

১৯৭৩ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জাত উন্নয়নের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়েছে এই উন্নত জাতের গরু।

গবাদি পশুর জাত উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে সাভারে ২হাজার ৬১৩ একর জমির উপর স্থাপিত হয় কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার। এই খামারে উন্নত জাতের ষাঁড় ও ষাঁড়ের বীজ উৎপাদিত হয় এবং সারা বাংলাদেশে তা বিতরণ করা হয়। এই প্রজনন কেন্দ্রে এখন ষাঁড়ের সংখ্যা ১২৬ টি। সারাদেশে উৎপাদিত মোট গরুর অর্ধেক বীজ সরবরাহ হয় এখান থেকে।

সাভারের কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্রে একটি ষাঁড়ের কোড নাম আরপি ১৯৪। ফ্রিজিয়ান শংকর জাতের এ ষাঁড় ৭ বছরে শুক্রানু দিয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ডোজ। প্রতিডোজ শুক্রানুর দাম ৭৫ টাকা ধরলে, প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে একটি ষাঁড় থেকে।

এরকম ১২৬ টা ষাঁড় থেকে সপ্তাহে একদিন করে শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। একটি ষাঁড় থেকে একবারে ৮ মিলিলিটার করে শুক্রাণু করে নেয়া হয়, যা গবেষণাগারে প্রস্তুত করা হয় ৫ শ' গাভির জন্য। অত্যাধুনিক ল্যাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে এর গুণগত মান বজায় রাখা হয়।

এরকম প্রতি স্ট্রতে স্পার্ম থাকে কমপক্ষে ২৫ মিলিয়ন শুক্রাণু। যা প্রজননের জন্য হিমায়িত করে রাখা হয়। এ অবস্থায় শুক্রাণু সংরক্ষণ করা যায় শত বছর। চাহিদার আলোকে তা পাঠিয়ে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

সাভারের কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শানে খোদা বলেন, 'অনেকগুলো থেকে ভালো মাংস ও দুধ দিবে সেইগুলোই সিলেকশন করা হয়। সেই ধরনের ষাঁড় থেকে আমরা সাধারণ সিমেন সংগ্রহ করি। এখান থেকে যে গাভীগুলো হবে সেগুলো কম খেয়ে বেশি দুধ দিবে, বাচ্চা বেশি হবে, তাদের অসুখ-বিসুখ কম হবে।'

১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৬ কোটি ৬২ লাখ ডোজ শুক্রাণু উৎপাদন হয়েছে। শুধু ২০২৩ সালে এখানে উৎপাদন হয়েছে ৩৫ লাখ ডোজ। শুধু শুক্রাণু বিক্রি করে গতবছর সরকারের আয় ৬২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা গতিশীল করতে আমেরিকা থেকে উন্নত জাতের ১০টি ফ্রিজিয়ান ষাঁড় ও ৫০টি বকনা এনেছে সরকার। আমেরিকান এক একটি গাভী ৬০ থেকে ৯০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। বাংলাদেশের ক্রস ফ্রিজিয়ান গাভিকে এ জাতের ষাঁড় দিয়ে ৫০ শতাংশ ক্রস ব্রিডিং করালে দুধের পরিমাণ বাড়বে কয়েকগুণ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. সফিকুর রহমান বলেন, 'যে গাভী থেকে এখন ৮ থেকে ১০ লিটার দুধ পাচ্ছি সে গাভীতে ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ পাওয়া সম্ভব।'

সরকারের পাশাপাশি সিমেন উৎপাদন করছে ব্র্যাক, এসিআই, আমেরিকান ডেইরি, ঠাকুরগাঁও ডেইরি, ইজাব অ্যালায়েন্স, লাল তীর, সজাগ ও মিল্কভিটা। দেশে মোট প্রজননক্ষম গাভীর সংখ্যা ১ কোটি ১৫ লাখ। এদের জন্য বছরে প্রয়োজন ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ শুক্রাণু। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ লাখ ডোজ আর বেসরকারি ১১ টি প্রতিষ্ঠান মিলে সিমেন উৎপাদন সক্ষমতা আরও প্রায় ৫০ লাখ ডোজ। বাকিটা পাওয়া যায় প্রাকৃতিকভাবেই।

দেশে মোট গরুর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৪৬ লাখ। যার প্রায় ৬০ শতাংশ দেশি গরু আর বাকিটা ফ্রিজিয়ান আর শাহীওয়াল।

দেশে গাবাদিপশু পালনের পরিসর বাড়লেও পশুর তথ্য সংরক্ষণ হয়না বেশিরভাগ খামারে। যাতে জানা যায়না পশুর জাত, খাদ্যাভ্যাস, রোগব্যধীসহ নানা তথ্য।

সাভারের কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শানে খোদা বলেন, 'আমার খামারিরা মাঠ পর্যায়ে রেকর্ড রাখতে চান না। রেকর্ড ছাড়া কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা বলতে পারবেন না।'

এ অবস্থায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার গবাদিপশুকে অনলাইন নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। নিবন্ধিত পশুর কানে লাগানো হবে বারকোড। এভাবে মানসম্পন্ন দুধ ও মাংস উৎপাদন করার জোর দেয়া হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. রেয়াজুল হক বলেন, 'মানসম্পন্ন উৎপাদন করতে গেলে তাকে তার খাবার মানসম্পন্ন দিতে হবে।  উৎপাদন আরও বেশি হয় আমরা সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি প্রতিদিন।'

কৃত্রিম পজননের মাধ্যমে দেশি পশুরও জাত উন্নয়ন সম্ভব। তাই ভালমানের দেশি ষাঁড় সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে।

ইএ

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর