শিল্প-কারখানা
অর্থনীতি
0

মধুপুরের নারীদের হাতে তৈরি কারুপণ্য যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়!

টাঙ্গাইলের রসুলপুর থেকে জলছত্র পর্যন্ত যে পথটা পারি দিতে হয় তা মূলত পৃথিবীর অন্যতম ঝড়াপাতার বন হিসেবে পরিচিত মধুপুরের শালবন। রসুলপুর বন বিট থেকে শ্যামল ছায়াঘন পিচ ঢালা পথের মিতালি টাঙ্গাইল সড়কে গিয়ে । প্রায় ৪৫ হাজার একর জমি নিয়ে মধুপুর বনাঞ্চলে এখন প্রাকৃতিক বন আছে প্রায় নয় হাজার একর বা তার কিছু বেশি জমিতে। রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে শাল, গজারি, বাঁশ, বেতসহ নানা ধরনের গাছ।

মধুপুর বনাঞ্চলে এখনও প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশিষ্ট আছে, জলছত্র কিংবা তার আাশপাশের কয়েকটি গ্রামে তার দৃশ্যমান হয় । মধুপুর বন ঝরাপাতার বন হওয়ায় শীতের শেষে বসন্তে পাতারা ঝরে যায়। জ্যৈষ্ঠ শেষে আষাঢ়ে বৃষ্টিতে ঝরা পাতারা বৃষ্টির পানিতে পচে। সেই পচে যাওয়া পাতা বনকে দেয় পুষ্টি, জন্মায় নতুন নতুন গাছ, সবুজ হয় পাতারা,আপন যৌবনে বেড়ে উঠতে থাকে লতাগুল্মসহ দুর্লভ বৃক্ষরাজিও।মূলত এমনই হয় শালবনের স্বভাব । তবে ক্রমাগত বনবিনাশ আর বন আর ভূমিখেকোদের দৌরাত্বে কমে এসেছে শাল গজারি বৃক্ষ। বনে জায়গা করে নিয়েছে এখন আকাশমনি- ইউক্লিপটাসসহ বিদেশী বৃক্ষরাজি। তবুও এখন কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে বনের শেষ ধ্বংসযজ্ঞের কেবল চিহ্ন মাত্র ।

জলছত্র থেকে গন্তব্য আপাতত পিরগাছার বর্মন পাড়া। তবে কিছুদূর এগুলেই চোখ আটকায় বেশ পুরনো সাইনবোর্ডে। তাতে লেখা 'কোর দি জুট ওয়ার্কস, কারিতাস সিল্ক'। চারপাশে বৃক্ষরাজি তার মধ্যে আধাপাকা পুরনো একটি কারখানার মতো। ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে মূল কর্মযজ্ঞ। একরকম দম খেলার খুসরত নেই কারোরই। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কেউ হাতে, কেউ মেশিনে বিরামহীন তৈরি করে যাচ্ছে কারু পণ্য। মুলত এখানে বাটিকের কাপড়ে তৈরী হচ্ছে মেয়েদের নান্দনিক ছোট ব্যাগ।

একজন কর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন অন্য এক সহকর্মী। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ

মধুপুরের গাছা বাড়ি গ্রাম থেকে কাজ করতে এসেছে এক কিশোরী। চোখ তার মেশিনের ধারালো তিক্ত সূচে, বিরামিন এই সেলাই থেকে চোখ ফেরানোর উপায় নেই যেনো। কারণ এই কাজ থেকে মাস শেষে আসে তার পরিবারের রোজগারের খরচ । কাছে গিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করতেই মেয়েটি কোন উত্তর দিল না, কেবলই হাসলো। কিছুটা অবাক হোলেও, পাশ থেকে এক জন যখন বলে উঠলো, 'ভাই মাইয়াডা কথা কইতে পারে না, বুবা (বোবা)।'

শেষমেষ কাগজে লিখে দিলো, 'আমার নাম বর্ষা।' অস্পষ্টভাবে নিজের নাম কয়েকবার বলার চেষ্টা করল। বর্ষা একা নয় এখানে কাজ করে তার সাথে তার মা ফাতেমা বেগম। ২০১৯ সাল থেকে মা মেয়ে দু'জনই এখানে কাজ করছে। প্রোডাকশনে কাজ করার ফলে মাস শেষে একজন ৬ থেকে ৭ হাজার করে টাকা আয় করতে পারে। দিনমজুর স্বামী বাবুল বাদশার একার খরচে সংসার চলে না বলে শেষমেষ মা মেয়ে দু'জনই এখানে কাজে নেয়।

বর্ষার রয়েছে ছোট ভাই ও ছোট বোন। সংসারের খরচ ভাই বোনদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে মা মেয়ে দু'জনই এভাবে সকাল সন্ধ্যা কারখানাটিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এখানে কাজ নেয়ার পর আগের থেকে অনেকটা ভালোভাবে চলতে পারছেন তারা। তবে মেয়ে বর্ষাকে নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই তার মায়ের।

আক্ষেপ করে বর্ষার মা ফাতেমা বেগম বলেন, 'জন্মের পর থেইকা ও কথা কইতে পারে না। স্কুলে কিছুদিন গেছিলো,পরে অভাবের লাইগা আর স্কুলে পাঠাইতে পারি নাই। মেয়েটা বড় হইতাছে আর চিন্তা বাড়তাছে। কয়েক বছর পর মেয়েটারে একটা ভালো পাত্রের হাতে বিয়া দিবার পারলেই শান্তি। প্রতিবন্ধী মেয়ে আমার কেডা বিয়া করব, তাই ভাবলাম এইখানে হাতের কামডা শিখা থাকলে ভবিষ্যতে কিছু কইরা খাইতে পারবো।'

মেশিনে সেলাই করা ব্যাগগুলোর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ

দি জুট ওয়ার্কস, কারিতাস সিল্ক যেভাবে তাদের যাত্রা শুরুঃ

দি জুট ওয়ার্কস, কারিতাস সিল্ক টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র সেন্টার ও বিক্রয় কেন্দ্রটি ১৯৯৬ সালে প্রথম যাত্রা শুরু করে। মূলত প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে অনগ্রসর নারী সমাজকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সাবলম্বী করে গড়ে তুলতেই কারিতাস নামের বেসরকারি এনজিও এই কারখানাটি স্থাপন করেন।

কারখানার স্থাপনের পর থেকেই সিল্কের ব্যাপক চাহিদা থাকায় তখন থেকেই বিদেশে তাদের উৎপাদিত পন্য রপ্তানি করতে শুরু করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। তবে পরবর্তী সময়ে সিল্কে ভাটা পড়লে অনেকটাই পড়ে আসে ব্যবসায়। কমে আসে সিল্কের পোশাক তৈরীর পরিধিও। আগে কারখানাটিতে শ্রমিকের সংখ্যা অধিক থাকলেও বর্তমানে প্রায় শতাধিক শ্রমিক এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে যাদের ৯০ ভাগই নারী।

শুধু তাই নয় বর্ষা আক্তারের মত প্রতিবন্ধী নারীও রয়েছেন সেখানে। কারখায় তৈরী হচ্ছে সিল্কের শাড়ি, পাঞ্জাবি, মেয়েদের পোশাক। এছাড়া কটনের শার্ট, ফতুয়া, গামছা, লুঙ্গি, বাটিকের তৈরি ছেলে মেয়েদের পোশাকও তৈরী হয় কারখানায়। কারিতাসের সিল্কসহ কারুপন্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ -আমেরিকাসহ কানাডার মতো দেশগুলোতে।

কারিতাসের সিল্কসহ বিভিন্ন পণ্য কিনতে আসছেন ক্রেতারা। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ

চলতি মাসে বাইরের দেশে রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৫০ হাজার পিস ব্যাগ তৈরীর অর্ডার পেয়েছে। যার বাজারমূল্য ৫০ লাখ টাকার উপরে, সেই সাথে ৩ লাখ টাকার সিল্ক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ইতোমধ্যে।

রেশমকে ইংরেজিতে সিল্ক বলা হয়। এক ধরনের গুটি পোকা থেকে এ ধরনের তন্তু বা সুতা বের হয়। এর মধ্যে কয়েকটি জাত রয়েছে, যা কাপড় বুনন এর কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব বিখ্যাত সিল্কের কাপড় হিসেবেও রেশমি কাপড়ের পরিচিতি আছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকেই চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিষ্কৃত হয়।

যদিও অন্য আরেকটি বিশ্বস্ত গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে ভারত তথা হিন্দুস্থানে রেশমেরর চাষ হতো এবং সিল্কের কাপড় বহির্বিশ্বে রপ্তানি করে অনেক ব্যবসায়ীরাই রাজপ্রাসাদ ও বিভিন্ন দেশের রাজমহলের ব্যক্তিদের উপহার ও উন্নত মানের কাপড় হিসেবে বিক্রি করে বিশাল অংকের স্বর্ণমুদ্রা আয় করতো। এছাড়াও আমাদের দেশে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া অঞ্চলসহ ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে অনেকেই রেশম কুটির চাষ করে থাকেন। ঢাকার নিকটস্থ অঞ্চল গাজীপুরে রেশম গবেষণাগার রয়েছে।

কারখানাটির ম্যানেজার মার্টিন গোমেজ বলেন, 'দক্ষ কারিগর ও সহযোগিতার অভাবে কারিদাসের সিল্ক কারখানাটি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। একসময় রেশম চাষ করে সুতা উৎপাদন করে আমরা কাজ করতাম। পড়ে আর চাষ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি নানা কারণে।'

গোমেজ আরও বলেন, 'যদি সংশ্লিষ্ট বিভাগ মধুপুরের পাহাড়ি এলাকায় এই রেশম চাষাবাদের সম্ভাবনা তৈরি করে তবে সিল্কের সেই হারানো গৌরব আবার ফিরে আসবে বলে মনে করি, সেই সাথে আরও বাড়বে কর্মসংস্থান। তৈরী পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে অর্জিত হবে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা।'

নিজেদের হাতে তৈরি ব্যাগ নিয়ে খুঁশি কারিগররা। ছবি: ইমতিয়াজ আহমেদ

কাজের অর্ডার পাওয়ার পরই রেশমি সুতা কিনে এনে কারখানাটি চালু থাকে বলে জানান তিনি । অর্ডার না থাকায় আপাতত বন্ধ রয়েছে তৈরির কাজ। বেকার পড়ে আছে মূল্যবান মেশিনারিজগুলো।

বছরে ৫০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয় বিক্রয় কেন্দ্র থেকেঃ

কারখানাটির পাশে রয়েছে একটি বিক্রয় কেন্দ্র। এই কারখানা থেকে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করা হয় ঢাকাতেও, কেননা ঢাকার মিরপুরেও রয়েছে তাদের আরও একটি বিক্রয় কেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখা যায় জলছত্রের এই কারখানা থেকে তৈরি পণ্যগুলো এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি । যা বিক্রির জন্য প্রস্তুত। ছোট বড়দের সিল্কের শার্ট, মেয়েদের সিল্কের জামা, ছেলেদের সিল্কের পাঞ্জাবি। কটন এবং বাটিকের তৈরি বাহাড়ি ডিজাইনের পোশাক বিক্রি হয় এই বিক্রয় কেন্দ্রে।

বিক্রয় কেন্দ্রের সেলসম্যান মুক্তা সিমসাং জানায়, 'মধুপুর মূলত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা, এছাড়াও বাঙালিদের বসবাসও অনেক, সবার কথা চিন্তা করে সবধরনের ডিজাইনের পোশাক তৈরি করি আমরা নিজেদের কারখানায়।'

কারখানার শ্রমিক বৃষ্টি রেমা, জয়নাল আবেদিন, সাজেদা বেগম, শিরিনা আক্তারজানান, একসময় বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হতো তাদের। কারিতাসের এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠার পর এখন দারিদ্র্যতা ঘুচেছে তাদের। কাজ বাড়লে তাদের আয় রোজগারও বাড়ে। বর্ষাকালে দুই মাস বন্ধ থাকায় বেস বেকারদের পড়তে হয় শ্রমিকদের।

আদতে আমাদের গ্রাম বাংলার এমন প্রত্যন্ত জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় শিল্প তথা কারিগররা। সরকারি কিংবা বেসরকারি এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একদিকে যেমন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে গ্রামীণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর।

এসএস