মাটির কোলে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে লাখো ইমারত। নগরীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, যতদূর চোখ যায় কেবলই আকাশছোঁয়া দালান। এতো এতো দালানের ভিড়ে হুমকিতে পড়েছে প্রাণ-প্রকৃতি।
ক্রমশই হারাচ্ছে প্রাকৃতিক শীতলতা। তিলোত্তমা শহর হয়ে উঠেছে তপ্ত। সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বৃক্ষের ছায়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী।
একজন পথচারী বলেন, 'লাখ লাখ টাকা দিয়ে গাছ এনে লাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু গাছগুলো মারা যাচ্ছে। কিছু গাছ আছে রাস্তার পাশে। এসব গাছ কোনো ফুল, ফলও দেয় না, কোনো ছায়াও দেয় না। নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করা হচ্ছে। নগরপরিকল্পনার কোনো কিছু করা হচ্ছে না।'
শহরে নিধনের বিপরীতে রোপণ করা হয়েছে খুবই কম গাছ। আর রোপণের সময়ও বিবেচনায় রাখা হয়নি মাটির ধরনের বিষয়টি। ঢাকার লাল মাটিতে ভালো জন্মাবে এমন বৃক্ষ হলো শাল, চালতা, আমলকী, গজারি, বকুলসহ বিভিন্ন দেশিয় প্রজাতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের প্রকল্পগুলোতে এসব বৃক্ষ রোপণ করা হয়নি। বরং ঢাকার বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, এসব বৃক্ষের পরিবর্তে রোপণ করা হয়েছে শোভাবর্ধক বনসাঁই, পাইন, বাগানবিলাস ও টগরের মতো গাছ।
রমনা পার্কে বিভিন্ন ধরনের গাছ। ছবি: এখন টিভি
২০১৭ সালে সড়ক ও জনপদ বিভাগ নগরীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে চীন ও তাইওয়ান থেকে এমন উচ্চমূল্যের বনসাঁই গাছ এনে লাগিয়েছিল বিমানবন্দর সড়কে। কিন্তু দেশের মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই না হওয়ায় সে সময় তৈরি হয়েছিল নানা সমালোচনা। উদ্ভিদ ও পরিবেশবিদরা বলছেন এ ধরনের উচ্চমূল্যের গাছ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতি করছে রাষ্ট্রকে, তেমনি এই ঢাকার বায়ুমান উন্নয়নে রাখতে পারছে না কোনো প্রকার ভূমিকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিহির লাল সেন বলেন, 'রাস্তার পাশেও যদি বড় গাছগুলো লাগানো হয়। যেমন বকুলের গাছটা যদি আমরা একটা উচ্চতায় রাখতে পারি এর কিন্তু অনেক পাতা, এই পাতা দিয়ে সে সালোকসংশ্লেষণ করবে। এর ফলে তাপ সরাসরি মাটিতে আসতে পারবে না।'
বনবিভাগের তথ্যমতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য। কিন্তু রয়েছে প্রায় ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া একটি আর্দশ নগরে সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ সবুজ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকার উত্তর সিটিতে ১৪ আর দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে ১০ শতাংশেরও কম। আর তাও উদ্যান কিংবা পার্ক কেন্দ্রিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ৫৮ শতাংশ গাছই বিদেশি প্রজাতির। শোভাবর্ধক উদ্ভিদ রয়েছে ৩৩ শতাংশ।
এছাড়া ঢাকার সড়কপথে রোপণ করা অধিংকাশ গাছই পরিচর্যার অভাবে ধুঁকছে। পাশাপাশি ছায়াদানকারী বৃক্ষগুলো ব্যক্তি পর্যায়েও অবহেলিত। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের গবেষণায় দেখা যায়, গত ২৮ বছরে শুধুমাত্র ঢাকাতেই প্রায় ৭৫ শতাংশ জায়গায় উঠেছে স্থাপনা। ভবণ নির্মানের ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপনের জন্য কোনো জায়গাই রাখা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণে বৃক্ষরোপণ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, 'গাছের কারণে পাখি, প্রজাপতি বা জীববৈচিত্রের অন্যান্য প্রাণি ভীষণভাবে প্রাণ সংহারি। কোথায় কিভাবে, কী ধরনের গাছ লাগানো হবে। স্কুল, কলেজ, খোলা জায়গায় একরকম, শিল্পাঞ্চলে আরেকরকম, জলের ধারে আরেকরকম মেনে গাছ লাগাতে হবে।'
এবারের তীব্র তাপপ্রবাহে টনক নড়েছে নগরবাসীর। গাছ না থাকায় অস্বাভাবিক গরমে দিশেহারা হয়েছে পথে নামা মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার পরিবেশ ও মাটি উপযোগী বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। পাশাপাশি গাছের পরিচর্যায় মালিও নিয়োগ দিচ্ছে সিটি করপোরেশন।
ঢকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, 'গতবার সিইচও দেখার পর প্রেসার দিয়ে দিয়ে আমরা দুইজন সুপারভাইজার নিয়োগ করেছি। আর ৪৭ জন মালি নেয়ার জন্য আমরা একটা টেন্ডার দিয়েছি।'
দেশিয় গাছপালাকে ঘিরে জন্ম নেয় ও বেড়ে ওঠে অনেক ধরনের লতাগুল্ম। আবার এসব দেশীয় গাছের ওপর নির্ভর করে নানা ধরনের পাখি ও কীট-পতঙ্গের বসবাস। তাই সবকিছু বিবেচনায় রেখেই বৃক্ষরোপণ প্রকল্প হাতে নেয়ার পরামর্শ পরিবেশবিদদের।