ভিটেমাটি সহায়-সম্বল বলে কিছুই নেই। নেই চলার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা অথবা কারো কারো আয় রোজগারের শারীরিক সক্ষমতাও নেই। মূলত, এসব লোকজনকে সাবলম্বী করতেই ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিধান যাকাত। বিত্তবানদের জন্য যা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে।
কথা ছিল, যাকাত নিয়ে ধনী যাবেন গরিবের দুয়ারে। কিন্তু যাকাতের জন্য গরিব কেন ধনীর দুয়ারে? পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গেল চার দশকে যাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এদের মধ্যে অসংখ্য নারী-শিশু রয়েছে। ইসলামি চিন্তাবিদদের মত, যাকাত গরিবের ধনীর অনুগ্রহ কিংবা করুণা নয় বরং এটি তার অধিকার।
ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর মুখতার আহমাদ বলেন, যাকাত ধনীদের পক্ষ থেকে কোন অনুগ্রহ নয়। বরং ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার আছে বলে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন। আর যাকাত না দেওয়ার কারণে সম্পদ অপবিত্র থেকে যায়।’
সাহাবীরা এমন পরিমাণে কাউকে যাকাত দিতেন পরবর্তীতে সে ব্যক্তির আর যাকাত নেয়ার প্রয়োজন হতো না। খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর আমলে যাকাত বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এতো সুন্দরভবে রূপায়িত হয়েছিল যে, একটা সময়ের পর সারাদিন ঘুরেও আরব দেশে যাকাত নেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। পরবর্তীতে আফ্রিকা মহাদেশে যাকাত বন্টনের আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের যাকাতের অর্থের ওপর নির্ভরশীল আফ্রিকার কয়েকটি দেশের গোটা অর্থনৈতিক অবকাঠামো। মূলত, একটি রাষ্ট্রের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যাকাত হলো সবচেয়ে সুন্দর অর্থনৈতিক রূপায়ন। কিন্তু তার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বর্তমান সময়ে।
প্রফেসর মুখতার আহমাদ বলেন, ‘ধরেন, আমার এক লাখ টাকা আছে, তাহলে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা যাকাত হবে। তাহলে আমি তো একজনকে স্বাবলম্বী করে দিতে পারবো না। সে কারণে যাকাত ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যাকাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে কোন গরিব লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন মানুষের সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা রুপা তথা ৬৫ হাজার টাকার বেশি কিংবা সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ তথা টাকার অংকে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৫ টাকার মালিক হলেই তার ওপর যাকাত বাধ্যতামূলক। তবে শর্ত হলো- ব্যক্তির এই সম্পদের স্থিতি সর্বনিম্ন একবছর হতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে যাকাত সংগ্রহের সম্ভাবনা নিয়ে ২০০৫ সালে একটি সমীক্ষা চালান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবীর হাসান। তার গবেষণার ফলাফল বলছে, ২০০১ সালে বাংলাদেশে যাকাত সংগ্রহের সম্ভাবনা ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে পুনরায় সমীক্ষা চালান তিনি। দ্বিতীয় ধাপের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাংক কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে ধনীদের যে সম্পদের হিসাব মিলেছে, সেখান থেকে সবমিলিয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা যাকাত সংগ্রহ করা যেতো। যা দিয়ে গোটা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পুরোপুরি বদল দেওয়া যায়।
অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘যাকাতের বিধানটাই হলো সমাজে যাতে বৈষম্য কমে যায়। এখানকার যাকাত ফান্ড তো অত্যন্ত অপ্রতুল। এতো কম তো হওয়ার কথা নয়।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতদরিদ্র, ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র। মোটাদাগে এদেরকে যাকাতভোগী বলা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ‘সঠিকভাবে যাকাত বণ্টন করলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশে কোন দরিদ্র মানুষ থাকবে না। প্রকৃত অর্থে দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।’
২০০৮ সাল থেকে দেশের যাকাত ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট। এই ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত সরকারের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। বর্তমানে তিনি সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত উত্তোলন না করলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব কখনোই দৃশ্যমান হবে না।’
বিশ্লেষকদের মত, সরকারিভাবেই যাকাত উত্তোলনের আওতা বাড়াতে হবে। আর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বছরে মাত্র ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার যাকাত উত্তোলন করে। যা কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থার ১০ ভাগের একভাগও নয়।