আরও পড়ুন:
ফিকাহবিদদের মতে সাজদাহ সাহুর বিধান: ওয়াজিব নাকি সুন্নাহ?
ইসলামের ৪টি প্রধান মাজহাব হলো হানাফী, মালিকি, শাফেয়ী এবং হাম্বলি। সাজদাহ সাহুর বিধান নিয়ে ইসলামি ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, যা এর গুরুত্বকে তুলে ধরে:
ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয়): হানাফি ও হাম্বলিদ এর দলিল হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উক্তি উল্লেখ করেন: ‘আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তোমরা যেমন ভুলে যাও, আমিও ভুলে যাই। যদি তোমাদের কেউ ভুলে যায়, তবে সে যেন দুটো সিজদা করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৭১)। এই মতটিই অধিক শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত।
সুন্নাহ (ঐচ্ছিক/অনুসরণীয়): মালেকি ও শাফেয়ীগণ মনে করেন, এটি কেবল কোনো সুন্নাত (যেমন সুরা ফাতিহার পর অন্য সুরা বা প্রথম তাশাহহুদ) ছেড়ে দেওয়ার ক্ষতিপূরণ করে। (আল-মাজাজি, আল-মুহাজ্জাব ফিল ফিকহ আল-মালিকি, পৃষ্ঠা ১৩১)
অধিকাংশ আলেম ও ফিকহবিদ (Fiqh Scholars) মনে করেন, যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এটি করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে নামাজ পূর্ণতা লাভ করে, তাই এটি ওয়াজিব (Wajib) বা অবশ্যকরণীয়।
সাজদাহ সাহু দেওয়ার সময়: সালামের আগে নাকি পরে? (Timing of Sajdah Sahw)
সাজদাহ সাহু সাধারণত দুই সময়ে দেওয়া হয়: সালামের আগে (Before Salam) অথবা সালামের পরে (After Salam)। এটি ভুলের ধরনের ওপর নির্ভর করে:
ভুলের প্রকারভেদ সাজদাহ সাহু দেওয়ার নিয়ম ওয়াজিব ছেড়ে গেলে সালামের আগে (যেমন: প্রথম তাশাহহুদ ভুলে গেলে) অতিরিক্ত কিছু করলে সালামের পরে (যেমন: অতিরিক্ত রুকু বা এক রাকাত আদায় করলে) সন্দেহ সৃষ্টি হলে সন্দেহের যে দিকটি প্রবল মনে হয়, তার ওপর ভিত্তি করে নামাজ শেষ করে সালামের পরে।
আরও পড়ুন:
যে কয়টি ক্ষেত্রে ‘সাজদাহ সাহু’ দেওয়া ওয়াজিব
নামাজের কোনো ওয়াজিব আমল (Necessary Act) ভুলক্রমে ছুটে গেলে অথবা কোনো অতিরিক্ত কাজ করে ফেললে সিজদাহ সাহু দেওয়া ওয়াজিব (বুখারি, হাদিস: ৩৮৬; আবু দাউদ, হাদিস: ৮৭৪)। দৈনন্দিন জীবনে নামাজে যে ভুলগুলো প্রায়শই হয়, তার বিধান হাদীসের আলোকে নিচে দেওয়া হলো:
সালাম ফেরানোর আগে কখন সাহু সিজদা ওয়াজিব? (ওয়াজিব ছুটে গেলে)
নামাজে কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে সাধারণত সালামের আগে সিজদা সাহু দিতে হয়। এটি নামাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে:
১. সুরায়ে ফাতিহা ও কেরাত ভুলে গেলে: ফরজ, নফল বা বিতর—যে কোনো নামাজের কোনো রাকাতে যদি সুরায়ে ফাতিহা বা অন্য কেরাত (সুরা) ভুলক্রমে পড়া না হয়, তবে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৯৩; নাসায়ি: ১২৪৩)
২. প্রথম বৈঠক বা তাশাহহুদ ভুলে গেলে: যদি তিন বা চার রাকাতের নামাজে প্রথম বৈঠক (First Sitting) বা সেই বৈঠকে তাশাহহুদ (Tashahhud) পড়তে ভুলে যাওয়া হয়, তবে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৮৮২)।
৩. তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে: যদি কেউ প্রথম তাশাহহুদ না পড়ে ভুলবশত তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায় (পুরোপুরি), ফিরে না এসে নামাজ পূর্ণ করার পর সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২২৪)
৪. কেরাতের ধারাবাহিকতা লঙ্ঘন: ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাতে কেরাত পড়া ভুলে গিয়ে শেষ দুই রাকাতে তা পড়লে ধারাবাহিকতা লঙ্ঘনের কারণে সালামের আগে সাহু সিজদা ওয়াজিব। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৫)
৫. বিতর নামাজের কুনুত ভুলে গেলে: বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে দোয়া কুনুত (Dua Qunut) পড়তে ভুলে গেলে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে। (বায়হাকি, হাদিস : ৪০৪২)
৬. প্রথম বৈঠকে অতিরিক্ত পড়া: যদি কেউ প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদের সঙ্গে ভুলবশত দরুদ ইত্যাদি অতিরিক্ত দোয়া পড়ে ফেলে, তাহলে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে। (মুসলিম, হাদিস: ৮৯৫)
৭. সিজদা বা রুকন ছুটে গেলে: যদি কেউ একটি সিজদা করে পরের রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তবে ওই রাকাত দুই সিজদা দিয়ে সম্পন্ন করার পর ছুটে যাওয়া সিজদাও এর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে এবং নামাজ শেষে সালামের আগে সাহু সিজদা দিতে হবে।
আরও পড়ুন:
সালাম ফেরানোর পরে কখন সাহু সিজদা? (অতিরিক্ত বা সন্দেহ হলে)
নামাজে কোনো কিছু অতিরিক্ত (Addition) করলে বা রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ (Doubt) হলে সাধারণত সালামের পরে সাহু সিজদা দিতে হয়:
৮. ভুলবশত অতিরিক্ত কাজ করলে: যদি কেউ ভুলবশত অতিরিক্ত এক রাকাত বা অতিরিক্ত রুকু, সিজদা আদায় করে ফেলে এবং সালামের পরে মনে পড়ে, তবে প্রথমে সালাম ফেরাবে, তারপর দুটি সিজদা দিয়ে পুনরায় সালাম ফেরাবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২২২)।
৯. নামাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগে সালাম: নামাজ শেষ হওয়ার আগে ভুলবশত সালাম ফিরিয়ে ফেললে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মনে পড়লে, বাকি নামাজ পূর্ণ করে সালাম ফেরানোর পর দুটি সিজদা দিয়ে আবার সালাম ফেরাবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৭১)।
১০. রাকাত সংখ্যায় সন্দেহ: যদি রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয় এবং সন্দেহের কোনো একটি দিক (যেমন চার রাকাত) প্রবল বলে মনে হয়, তবে সেই প্রবলের ওপর ভিত্তি করে নামাজ শেষ করে সালাম ফেরানোর পর দুটি সিজদা দিতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০১)।
জামাতে সাজদাহ সাহুর নিয়ম: ইমাম ও মুক্তাদি (Rules in Congregation)
ইমামের ভুল: যদি ইমামের (Imam) কোনো ভুল হয়, তবে মুক্তাদিরা (পিছনের মুসল্লিরা) তাঁকে অনুসরণ করবেন। ইমাম সালাম ফিরিয়ে সিজদা দিলে মুক্তাদিরাও দেবেন।
মুক্তাদির ভুল: যদি মুক্তাদি নিজে ভুল করেন, কিন্তু ইমাম কোনো ভুল না করেন, তাহলে মুক্তাদির সাজদাহ সাহু লাগে না, কারণ, এই অবস্থায় ইমামের অনুসরণ করাই মুখ্য। (ইবনে উসাইমিন, আশ-শারহ আল-মুমতি’ আলা যাদ আল-মুসতাকনি’, ৩/ ৪২৬)।
মাসবুক ব্যক্তির ভুল (Missed Rakats): যদি মুক্তাদির কিছু রাকাত ছুটে যায় (মাসবুক), তবে তিনি ইমামকে অনুসরণ করে ইমামের সঙ্গে সালাম না ফিরিয়ে উঠে বাকি নামাজ পূর্ণ করবেন। এরপর তাঁর নামাজ পূর্ণ করার সময় যদি কোনো ভুল হয়, তবে তিনি তার ভুলের জন্য সাজদাহ সাহু দেবেন।
আরও পড়ুন:
সাজদাহ সাহুতে কী বলতে হয়?
সাজদাহ সাহুতে সিজদার সাধারণ তাসবিহগুলোই (Tasbih) বলা হয়। অতিরিক্ত কোনো নির্দিষ্ট দোয়া বা জিকির বলার প্রয়োজন নেই।
তাসবিহ: “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” (মহাপবিত্র আমার প্রতিপালক, যিনি সুউচ্চ) অন্তত তিনবার বলা।
দোয়া: মাঝে মাঝে অন্যান্য সিজদার দোয়া যেমন “সুবহানাকাল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া বিহামদিকা, আল্লাহুম্মাগফিরলি” (হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক, তোমার প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো) বলা যেতে পারে।
হাদিসে এসেছে- হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই সেজদার মাঝে বলতেন,
اَللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ وَارْحَمْنِي وَاهْدِنِيْ وَعَافِنِيْ وَارْزُقْنِيْ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগফিরলি, ওয়ারহামনি, ওয়াহদিনি, ওয়া আফিনি, ওয়ারযুকনি। (মুসলিম, মিশকাত)
অর্থ : হে আল্লাহ আপনি আমাকে মাফ করুন, আমাকে রহম করুন, আমাকে হেদায়েত দান করুন, আমাকে শান্তি দান করুন এবং আমাকে রিজিক দান করুন।
নামাজের কোনো ওয়াজিব আমল কেউ যদি ইচ্ছা করে (Deliberately) ছেড়ে দেয়, তবে সে গুনাহগার হবে এবং সেই নামাজও নষ্ট হয়ে যাবে। তখন সিজদাহ সাহুর মাধ্যমে নামাজ পূর্ণ হবে না, বরং নামাজটি আবার (পুনরায়) আদায় করা ওয়াজিব। সাজদাহ সাহু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ করুণা, যা আমাদের ভুলে ভরা ইবাদতকে ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণ করে তোলে।





