মৃত্যুর এক সপ্তাহের বেশি সময় পরও অ্যালেক্সি নাভালনির মরদেহ নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। স্বাভাবিক মৃত্যু উল্লেখ করে ডেথ সার্টিফিকেটে তার মাকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তার মরদেহ গোপনে কারাগারের ভেতরেই দাফন করার হুমকি দিয়েছে রুশ সরকার। নাভালনিকে নভিচক বিষ প্রয়োগ ও তার মৃত্যুর পেছেনে পুতিনকে দায়ী করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব।
রুশ ভাষায় নভিচক মানে নবাগত। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে ক্ষতিকর নভিচক বিষ তৈরি করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের চোখের আড়ালেই এর কার্যক্রম চালিয়ে যায় রাশিয়া। অন্যান্য রাসায়নিক বিষ থেকে নভিচক পাঁচ থেকে আটগুণ বেশি বিষাক্ত। যা শনাক্ত করাও অনেক কঠিন।
নব্বইয়ের দশকে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রথমবারের মতো নভচিকের কথা প্রকাশ করেন রসায়নবিদ ড. ভিল মির্জাইয়ানভ। এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে 'স্টেট সিক্রেটস' নামক বইয়ে নভিচকের গোমর ফাঁস করেন।
রুশ রসায়নবিদ ড. ভিল মির্জাইয়ানভ বলেন, নভিচক বিষের পর্যাপ্ত ডোজ প্রয়োগে খিঁচুনি, বমি ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। এটি ভয়াবহ রকমের যন্ত্রণা তৈরি করে, যা কল্পনা করা অসম্ভব। খরগোশ ও কুকুরের ওপর প্রয়োগ করে এর ভয়াবহতা পরীক্ষা করা হয়েছে। অল্প মাত্রায় প্রয়োগে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যথা থাকে। খুবই খারাপ ধরনের বিষক্রিয়া এই নভিচক।
২০১৮ সালে সাবেক এক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়েকে নভিচক বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ উঠে। তখনই এই রাসায়নিক বিষ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ঠিক তার দুই বছর পর পুতিনের কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনিকে ভয়ানক এই বিষপ্রয়োগ করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সামনে আসে। যদিও এসব ঘটনার সবই অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, জার্মানিতে নাভালনির সঙ্গে কী করা হয়েছে তা কেউ জানে না। প্রথমে জার্মানির স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসকরা তার শরীরে কিছুই খুঁজে পাননি। পরে সামরিক ক্লিনিকে স্থানান্তরের পর নভিচক শনাক্তের অভিযোগ ওঠে। এমনকি তারা আমাদের পরীক্ষার রিপোর্টও দিতে রাজি হয়নি। এগুলো সবই রাজনৈতিক চাল।
নাভালনির অন্তর্বাসের মধ্যে নভিচক বিষ দেয়া হয়েছিল। যা পরে তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সাইবেরিয়া থেকে বিমানে যাত্রার সময় মাঝ আকাশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত জার্মানি নেয়া হয়। পরে তার বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল পরীক্ষায় নভিচক বিষের উপস্থিতি পাওয়ার দাবি করেন জার্মান চিকিৎসকরা। শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান নাভালনি। ২০২১ সালে মস্কো ফেরার পথে তিনি গ্রেপ্তার হন। তখন থেকেই পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী এই নেতা কারাগারে ছিলেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারেই মৃত্যু হয় ৪৭ বছর বয়সী এই নেতার।
নভিচক শরীরে ঢুকলে প্রথমে স্নায়ুকে অকেজো করে ফেলে। শ্বাসকষ্ট ও দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানুষ। কঠিন বা তরল দুই অবস্থাতেই নভিচক সক্রিয়। পানিতে মেশালেও এর গঠন বদলায় না। আর বোতলে মজুত করলে কয়েক মাস বা বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। যদিও এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কারণ নভিচক নিয়ে গবেষণা হয়েছে খুব কম। তবে প্রয়োগের মিনিট দুইয়ের মধ্যে এটি পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর হয়ে ওঠে। এটি খাবার, শ্বাস-প্রশ্বাস এমনকি পোশাক থেকেও মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়।
নভিচক তৈরির পুরো প্রক্রিয়া রাশিয়ার আয়ত্তে এবং এটিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা শুধু তাদেরই আছে। রাশিয়ার দাবি, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপের পর এই ধরনের রাসায়নিক বিষ তৈরির সব কার্যক্রম বন্ধ আছে। ২০১৭ সালে পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে মজুত করা ৪০ হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জাতীয় বিষ তৈরির উপাদানগুলো কখনো নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কারণ এর রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কোন তথ্য নেই।