সবুজ প্রকৃতির বুকচিরে কংক্রিটের রানওয়েতে আকাশযানের এমন রোমাঞ্চকর অবতরণ, উত্তরের উপজেলা শহর সৈয়দপুরকে দিয়েছে পরিচয়ের নতুন মাত্রা। রেল থেকে বিমান, সৈয়দপুর হয়ে উঠেছে, নির্ঘুম রাতের এক বৈচিত্র্যময় শহর।
দেড়শ' বছরের পুরোনো শহর সৈয়দপুরের একদিকে যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অন্যদিকে এখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ, ভাষার বৈচিত্র্য আর বহুমাত্রিক বাণিজ্যের অবারিত সুযোগ। চার দশক ধরে সৈয়দপুর বিমানবন্দর দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে উত্তর জনপদের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য। আর ঠিক এ কারণেই ২০১৭ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উন্নয়নের জন্য সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে বেছে নেয়া হয় এ অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের হাতিয়ার হিসেবে।
এরপর ২০১৯ এ মার্চে শুরু হয় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে শুরু হয় প্রায় ৯১২ একর জমির অধিগ্রহণের কার্যক্রম।
ব্যবসায়ী মশিউর রহমান মন্ডল বলেন, 'কয়েকবার, জাতীয় সংসদে একবার, ভারত থেকে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে একবার এবং সবশেষ রংপুর বিভাগের একটি জনসভায় এই সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার কথা বলেছেন।'
কথা ছিল ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রমের পর চার বছর সময়সীমার মধ্যে করা হবে রানওয়ে সম্প্রসারণ। তবে নোটিশ জারি করা এই ৯১২ একর জমির মধ্যে সরকারি তিনটি সংস্থার রয়েছে ৬০ একর। বাকি জমির মধ্যে সৈয়দপুরের ৫৯৫ আর পার্বতীপুরে ৩১৭ একর ব্যক্তি মালীকানাধীন জমির অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ঝুলে আছে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। বিভিন্ন সময় বিগত সরকার এখানে উন্নয়নের বাগাড়ম্বর করলেও এসব জমি মালিকদের কাছে হয়ে আছে গলার কাঁটা।
সৈয়দপুর রিজিওনাল বিমানবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আনিসুল ইসলাম মন্ডল বলেন, 'প্রথম যে নোটিশটি দেযা হয়, বলা হয় যে এই জমিতে এখন থেকে এখানে আর কোনো ঘর-দুয়ার করা বা বৃক্ষরোপণ বা কোনো ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা যাবে না।'
নীলফামারীতে ২১৪ একর এলাকা জুড়ে উত্তরা ইপিজেড বদলে দিয়েছে উত্তরের কয়েক জেলার মানুষের ভাগ্য। ২৪টি দেশি-বিদেশি কোম্পানিতে উৎপাদন হচ্ছে রপ্তানিমুখী পণ্য। ব্যক্তি উদ্যোগেও সৈয়দপুরে গড়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের শত শত কারখানা। এছাড়া ২০২১ সালের নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারীর ঢাকা সফরেও নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যাতায়াত সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সংযোগের বিষয়ে আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু সকল সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করে কেবলমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এ বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক হাব করার প্রকল্প ফাইলবন্দি করে রাখে আওয়ামী লীগ সরকার। এমন অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী তানবীর হোসেন আশরাফী বলেন, '১৬ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিয়ে তার একটা ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে মাত্র সাড়ে চার হাজার বা পাঁচ হাজার বাজেট বরাদ্দ হলেও এর কোনো বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি।'
ট্যুরিজম ও ট্রাভেল ব্যবসায়ী শাহ জাহান লিটন বলেন, 'আমাদের এই এয়ারপোর্টের রানওয়ে বড় করা যায়। মানে রানওয়ে বড় করলে বোয়িং বিমানগুলো এখানে নামবে। এখান থেকে যদি সরাসরি ফ্লাইট যায় আমার মনে হয় না, তাদের সাথে আমাদের কোনো বিজনেস ঘাটতি হবে।'
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। আকাশপথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৪৮ মিনিট। ঢাকা ও কক্সবাজার থেকে সৈয়দপুর রুটে প্রতিদিন ৩০টিরও বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করছে চারটি বিমান সংস্থা। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল শুরু করলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাতটি রাজ্যের নিকটতম বিমানবন্দরগুলোয় আকাশপথে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৫০ মিনিট। বাড়বে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পর্যটন ও বাণিজ্য।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেন, 'অলরেডি আমাদের অফিসে যারা আছে তাদের নির্দেশনা দিয়েছি যে এই প্রজেক্ট যেন দ্রুত এগোতে পারি আমরা সেই ব্যাপারে যেন আমরা পত্র লিখি। এবং শুধু পত্র না আমরা যেন সরাসরি সংযোগ স্থাপন করি, নিজেরা নিজেরা।'
বিগত সরকারের আমলে বাজেট বরাদ্দে বৈষম্যের শিকার হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ কেবল সৈয়দপুর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিকীকরণে গাফিলতি নয়, আওয়ামী লীগের আমলে ভারতের আপত্তিতে আটকে দেয়া হয়েছে ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর আর লালমনিরহাটে বিমানঘাঁটির উন্নয়ন কাজও। তবে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব ধরনের বৈষম্য ও ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ চান উত্তরের কোটি মানুষ।