হাতে থাকা চশমাটা আরও একবার ভালো করে মুছে চোখে নিলেন সিরাজুল মাস্টার। তাতে কিছুটা স্পষ্ট হয় চারপাশের দৃশ্যপট। নীলগঞ্জ স্টেশনের পাশের টংয়ে বসলেই তার মনে পড়ে পুরানো দিনগুলি। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরও উদাসীন হয় স্মৃতিকাতরতা।
ছেলেবেলায় দেখতেন ধোঁয়া ছেড়ে ছুটে আসতো রেলগাড়ি। ট্রেন বোঝাই করা ধান, পাট, সবজি চলে যেত দেশের বিভিন্ন জেলায়। কত সাহেবরা এসে নামতেন এই গাড়ি থেকে। তাদের জন্যে থাকতো আলাদা কামরা। ছোটবেলায় এই এক ট্রেন দেখার জন্য কতই না অপেক্ষা ছিল। ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পেলেই দুরন্ত গতিতে ছুটে আসতো সিরাজুলের দল।
সিরাজুল বলেন, 'কয়লা দিয়ে যখন ইঞ্জিন চলতো তখন ভো ভো করে শব্দ করতো। তখন আশেপাশের পুরুষরা তো আসতোই মহিলারা পর্যন্ত আসতো স্টেশনে দেখতে।'
সেসময় ইংরেজরা আশপাশের জমিতে নীল চাষ করায় এই এলাকার নাম হয় নীলগঞ্জ। এই নীল চালান হতো এই রেলস্টেশনে দিয়েই। কারণ অত আগে এই অজপাড়া গায়ের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তাই রেলগাড়িই ছিল ভরসা। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে রূপ হারায় স্টেশনটি। ১৯৭১ এর পর তা প্রায় নিভে আসে। এখন আর কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন থামে না। তবে একটি মালবাহী লোকাল ট্রেন দাঁড়ায় কিছু সময়ের জন্য। তাও নিয়মিত নয়।
স্থানীয় একজন বয়োবৃদ্ধ বলেন, 'নীলগঞ্জ স্টেশনে ১০০ জনের উপরে কুলি ছিল। একটা গাড়ি আসলে কুলিরা নিজে শুধু মাছই তুলতো। আর আমরা এখন বেকার।'
রেলস্টেশনের প্রায় সবকিছুরই এখন ভগ্নদশা। পরে থেকে নষ্ট হচ্ছে ব্লক মেশিন, সিগন্যাল ল্যাম্পপোস্ট, সিগন্যাল ক্যাবল, সিগন্যাল কেবিন, টেলিযোগাযোগ যন্ত্র, রেডিও সেটসহ ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। টিকেট কাউন্টারে ঝুলছে মাকড়সার জাল। মাস্টারের কামরায় ঝুলছে তালা। নীলগঞ্জ স্টেশনে এখন আর টিকেট কাটতে বা ট্রেনের সময় জানতে ভিড় কেউ করেন না। ডাকবাক্সটিও চিঠির অপেক্ষায় থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন না থামায় সিগন্যাল কক্ষটিও বন্ধ।
নীলগঞ্জ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মো. খলিলুর রহমান বলেন, 'যদি লোকাল ট্রেনগুলো চালু হয় তাহলে স্টেশনটা পূর্বের ন্যায় বাণিজ্যিক স্টেশন হিসেবে ফিরে আসবে।'
এই স্টেশনের পাশেই কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি থাকায় একসময় বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় ধরে রেল যোগাযোগ একেবারে বন্ধ থাকায় তেমন কেউ আসছেন না। স্টেশনকে ঘিরে জমে উঠেছিল বড় বাজার। জৌলুস হারিয়েছে সেই বাজারটিও।
সিরাজুল মাস্টার এখনও ভাবছেন। এর মধ্যে শেষ হয়ে এসেছে কাপের চা। হাটের দিন হওয়ায় এক এক করে শুরু হয়েছে মানুষের আনাগোনা। কেউ মাছ নিয়ে বসেছে, কেউ এনেছে শুঁটকি অথবা কেউ বসেছে কলার ঝুড়ি নিয়ে। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জুলমাত। জীর্ণ পা দুটো টেনে নিয়ে চললেন বাড়ির পথে। তিনি যাচ্ছেন। খেয়াল নেই কারও। তবে তাকিয়ে রইলো কেবল তার চেয়েও বুড়ো, আধভাঙা, পলেস্তারা খসে পড়া এই স্টেশন।
গল্পের সেই নীলগঞ্জ স্টেশন আবারও ফিরে পাক তার জৌলুস। ভোঁ ভোঁ করে ছুটে চলুক ট্রেন। ব্যস্ত হয়ে উঠুক সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিভাগ। ফিরে আসুক বাণিজ্যিক ধারা এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।