মুমূর্ষু ব্যক্তিকে কালিমার তালকিন (Inculcating Kalimah to the Dying)
যখন কারো মৃত্যুর আলামত প্রকাশ পায় (মুতাহাযির অবস্থা), তখন তার পাশে বসে মৃদু স্বরে কালিমা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পাঠ করা সুন্নাত। একে বলা হয় 'তালকিন'।
পদ্ধতি: মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে এমনভাবে কালেমা পড়তে হবে যেন সে তা শুনতে পায়।
সতর্কতা: তাকে কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করে কালেমা পড়ার জন্য জোরাজুরি (Coercion) করা যাবে না। কারণ কষ্টের তীব্রতায় সে বিরূপ কিছু বলে ফেলতে পারে। একবার কালেমা পাঠ করলে আর পড়ার প্রয়োজন নেই, যতক্ষণ না সে অন্য কোনো দুনিয়াবী কথা বলে।
হাদিস: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের মৃত্যুগামী ব্যক্তিদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র তালকিন করো।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৯১৬)
আরও পড়ুন:
মৃতের পাশে কোরআন তেলাওয়াতের মাসায়েল (Masail of Recitation near Deceased)
মৃত ব্যক্তির পাশে বসে তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে সময়ের পার্থক্যে বিধান ভিন্ন হয়:
১. গোসলের পূর্বে (Before Washing the Body): লাশ গোসল করানোর পূর্বে তার পাশে উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করা অনুচিত বা মাকরূহ (Makruh)। তবে যদি লাশটি কাপড় দিয়ে সম্পূর্ণ আবৃত থাকে, তবে নিচু স্বরে বা কিছুটা দূরে বসে তেলাওয়াত করা যেতে পারে।
২. গোসলের পরে (After Ghusl): মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর পর লাশের পাশে বা শিয়রে বসে কোরআন তেলাওয়াত করাতে কোনো বাধা নেই; বরং এটি সওয়াবের কাজ।
৩. জিকির ও দোয়া (Dhikr and Supplication): মৃত ব্যক্তির পাশে বসে তসবিহ পাঠ, দরুদ শরিফ এবং মাগফিরাতের দোয়া যে কোনো অবস্থায়ই (গোসলের আগে বা পরে) জায়েজ এবং উত্তম।
আরও পড়ুন:
মৃত ব্যক্তির পাশে কোরআন তেলাওয়াত ও সূরা ইয়াসীন পাঠ: সুন্নাহ নাকি বিদআত?
নারী-পুরুষের পর্দা ও তেলাওয়াতের আদব (Etiquettes & Segregation)
মৃত ব্যক্তির পাশে দোয়া বা তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্দার বিধান অবশ্যই মেনে চলতে হবে:
গাইরে মাহরাম (Non-Mahram): পরপুরুষ বা পরনারী লাশের পাশে বসে পাশাপাশি অবস্থান করে তেলাওয়াত বা দোয়া করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
মাহরাম নারী (Mahram Women): পুরুষ মাইয়েতের ক্ষেত্রে মাহরাম নারী (মা, বোন, স্ত্রী) পাশে বসে দোয়া করতে পারেন। তবে অন্য নারীরা অংশ নিতে চাইলে ভিন্ন রুমে বা দূরত্ব বজায় রেখে পড়া উত্তম।
ভাড়াটে পাঠক: টাকা দিয়ে বা লোক দেখানোর জন্য আলেম/ছাত্র ডেকে কোরআন খতম করানো বা একে আবশ্যক মনে করা বিদয়াতের (Bid'ah) শামিল। তবে যদি তারা সওয়াবের উদ্দেশ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন, তবে তা জায়েজ।
তবে আধুনিক ইসলামি গবেষক ও ফিকাহবিদগণ কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে বলছেন, কেউ মৃত্যুবরণ করলে বা মুমূর্ষু অবস্থায় থাকলে তার পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত বা সূরা ইয়াসীন পাঠ এসকল আমলের অনেকগুলোই সুন্নাহসম্মত নয়, বরং বিদআত (Bid'at/Innovation) হিসেবে গণ্য।
আরও পড়ুন:
কোরআন জীবিতদের জন্য, মৃতদের জন্য নয়
পবিত্র কোরআন মূলত নাযিল হয়েছে জীবিত মানুষের জীবনবিধান হিসেবে। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বিধান জীবিতদের ওপর প্রযোজ্য করেছেন।
কোরআনের আমল: একজন ব্যক্তি জীবিত থাকাকালীন নিজে কোরআন শেখা এবং অন্যকে শেখানোই তার জন্য আসল নেকির কাজ। এটিই মৃত্যুর পর তার আমলনামায় সদকায়ে জারিয়া (Sadaqah Jariyah) হিসেবে যোগ হতে থাকে।
মৃতের পাশে তেলাওয়াত: অনেক আলেমের মতে, মৃত ব্যক্তির পাশে বা কবরের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। জীবিত থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, সেই প্রকৃত সফল।
মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে সূরা ইয়াসীন পাঠের বিধান
আমাদের সমাজে মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার একটি ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
হাদিসের বিশ্লেষণ: এ সংক্রান্ত যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, মুহাদ্দিসগণের মতে তার অধিকাংশই দুর্বল বা যঈফ। বিশুদ্ধ ইসলামি বিধান অনুযায়ী, মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে সূরা ইয়াসীন পাঠের বিশেষ কোনো বাধ্যবাধকতা বা সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নেই।
সঠিক আমল: মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে বসে মৃদু স্বরে কালেমার তালকিন (Talqin of Kalimah) করা এবং তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করাই হলো সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি।
কবরের পাশে তেলাওয়াত ও বিদআত প্রসঙ্গ
ইসলামি আইনবিদদের একটি বড় অংশের মতে, কবরের পাশে কোরআন তেলাওয়াত করা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।
বিদআত সতর্কতা: ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতির বাইরে নতুন কিছু করাকে ইসলামে বিদআত বলা হয়।
সঠিক পদ্ধতি: কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃত ব্যক্তির গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করা এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই ইসলামের মূল শিক্ষা।
আরও পড়ুন:
দাফন-কাফনে বিলম্ব না করার গুরুত্ব (Importance of Quick Burial)
ইসলামে মৃত ব্যক্তিকে দ্রুত দাফন করার ব্যাপারে কঠোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিনা কারণে লাশ দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখা অনুচিত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপদেশ: “হে আলী! তিনটি জিনিসের ক্ষেত্রে বিলম্ব করবে না। ১. ওয়াক্ত হলে নামাজ, ২. জানাজা উপস্থিত হলে দাফন এবং ৩. উপযুক্ত পাত্র পেলে অবিবাহিতা মেয়ের বিয়ে।” (তিরমিজি ১/২০৬)
যৌক্তিক কারণ: হাদিসে এসেছে, মৃত ব্যক্তি নেককার হলে তাকে দ্রুত তার গন্তব্যে (জান্নাতে) পৌঁছে দেওয়া উচিত, আর বদকার হলে তার আপদ দ্রুত কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলা উচিত। (বুখারি, হাদিস ১৩১৫)
মৃত্যুর পর জীবিতদের করণীয়
তাৎক্ষণিক করণীয় ও জানাজার প্রস্তুতি
কোনো মুমূর্ষু ব্যক্তি মারা গেলে প্রথম কাজ হলো তার চোখ দু’টো খোলা থাকলে আলতো করে বন্ধ করে দেওয়া।
ফেরেশতাদের আমীন: মৃত্যুর পরপরই মাইয়েতের জন্য উত্তম দোয়া করা উচিত। কারণ হাদিস অনুযায়ী, উপস্থিত ব্যক্তিরা তখন যে দোয়া করেন, ফেরেশতাগণ তাতে 'আমীন' (Ameen) বলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়া: রাসূল (সা.) আবু সালামার মৃত্যুর পর তার চোখ বন্ধ করে দিয়ে দোয়া করেছিলেন— “হে আল্লাহ! আপনি তাকে মাফ করুন, তাকে উচ্চ মর্যাদা দিন এবং তার কবরকে প্রশস্ত ও আলোকিত করুন।”
ঋণ পরিশোধ ও দ্রুত দাফন
- মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন পরানোর পর জানাজার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার ঋণ পরিশোধ (Debt Repayment) করা।
- নিকটাত্মীয় বা অন্য যে কেউ তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারে।
- জানাজার নামাজ শেষে দ্রুত দাফন সম্পন্ন করা সুন্নাত। দাফনের পর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাত না তুলেই প্রত্যেকে দোয়া করবেন। এ সময় 'আল্লাহুম্মাগফিরলাহু ওয়া ছাব্বিতহু' (হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন এবং তাকে দৃঢ় রাখুন) বলা যেতে পারে।
শোক পালন ও মাতম বর্জন
ইসলামে মৃত ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালনের অনুমতি আছে। তবে স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর এই সময়কাল হলো চার মাস দশ দিন (Iddah/Mourning period for widow)।
সতর্কতা: মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বিলাপ করা, গাল চড়ানো বা মাতম করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে মৃত ব্যক্তির আত্মার কষ্ট হয়।
আরও পড়ুন:
মৃত্যুর পরও যে আমলগুলো জারি থাকে (Sadaqah Jariyah)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী, মৃত্যুর পরও মুমিন ব্যক্তির আমলনামায় সাতটি বিশেষ কাজের সওয়াব যোগ হতে থাকে:
১. দ্বীনি ইলম (Religious Knowledge): যা সে শিক্ষা দিয়েছে এবং প্রচার করে গেছে।
২. নেক সন্তান (Pious Offspring): যারা পিতামাতার জন্য নিয়মিত ক্ষমা প্রার্থনা করে।
৩. কোরআন বিতরণ (Quran Distribution): যা সে মীরাছ বা উপহার হিসেবে রেখে গেছে।
৪. মসজিদ নির্মাণ (Mosque Construction): যা সে নিজের অর্থায়নে করে গেছে।
৫. মুসাফিরখানা ও জনকল্যাণ: পথিকদের জন্য আশ্রয়স্থল বা খাল-পুকুর খনন করে যাওয়া।
৬. বৃক্ষ রোপণ: বিশেষ করে ফলজ গাছ যা থেকে মানুষ বা প্রাণীরা উপকৃত হয়।
৭. দান-সদকা: সুস্থ ও জীবিত অবস্থায় তার সম্পদ থেকে যা দান করে গেছে।





