ডেঙ্গু থামেনি, এবার কিউলেক্সের হানা: নগরজীবনে নতুন ঝুঁকি

ডেঙ্গুবাহী মশা
ডেঙ্গুবাহী মশা | ছবি: এখন টিভি
2

শহরের জনজীবনে মশা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে চিহ্নিত। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়াসিসের মতো প্রাণঘাতী রোগের প্রধান বাহক হওয়ায় এর প্রভাব শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মশা নিয়ন্ত্রণ একটি কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে। প্রজননস্থল ধ্বংস ও প্রতিরোধমূলক উদ্যোগই এই সমস্যার মূল সমাধান।

বর্তমানে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এবং এডিস মশার ঘনত্বও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ নিলে হয়তো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হত।

বাংলাদেশের নগর পরিবেশে মূলত দুটি প্রজাতির মশার আধিপত্য দেখা যায়—এডিস ও কিউলেক্স। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়, যেমন ড্রাম, বালতি, টব বা টায়ারে জমে থাকা পানি। 

অপরদিকে কিউলেক্স মশা প্রজনন করে নোংরা নালা, ড্রেন, লেক ও স্থবির পানিতে। বর্তমানে বৃষ্টির কারণে ড্রেন ও নালার পানি প্রবাহ সচল থাকায় কিউলেক্সের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম হলেও এটি কেবল সাময়িক। 

বৃষ্টির মৌসুম শেষে কিংবা শীতকালে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে, যা নাগরিক জীবনে তীব্র ভোগান্তি সৃষ্টি করবে এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত করবে।

এডিস মশার প্রজননস্থল শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা কঠিন হলেও কিউলেক্স মশার উৎস চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। 

এডিস নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি হলেও, কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।

নগরের লেক, ডোবা ও ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, স্থবির পানি জমতে না দেয়া এবং নালা-নর্দমার প্রবাহ সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি।

আরও পড়ুন:

সরকারি ও বেসরকারি ভবনের ভাঙা বা খোলা সেপটিক ট্যাঙ্ক দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন, কারণ এসব স্থানেই বিপজ্জনক আর্মিজেরাস মশার বিস্তার সবচেয়ে বেশি ঘটে। লেক ও জলাশয়ের কচুরিপানা অপসারণও অপরিহার্য, কারণ এখান থেকেই ম্যানসোনিয়া মশা জন্মায়। 

সাথে সাথে লেক ও তার তীরবর্তী স্থানে জমে থাকা আবর্জনা ও জৈব বর্জ্যও পরিষ্কার রাখতে হবে। কারণ এগুলো শুধু মশার প্রজননস্থল নয়, বরং নগরের জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির কারণ হিসেবেও কাজ করে।

বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, প্রথমে অবহেলার কারণে এক সময় লেক ও ডোবা মশার লার্ভায় পূর্ণ হয়ে যায়। তখন কীটনাশক ব্যবহার করেও নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়া একবার মশার সংখ্যা বেড়ে গেলে পপুলেশন সাবপ্রেস করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। 

প্রশাসনকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে সবাইকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে, যাতে কার্যক্রমের ফলপ্রসূতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত মনিটরিং, গবেষণালব্ধ তথ্যের ব্যবহার এবং টেকসই নগর পরিকল্পনা ছাড়া কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বৃষ্টির পরবর্তি সময়ে ও শীত মৌসুমে কিউলেক্সের তীব্র উপদ্রব নাগরিক জীবনে নতুন ভোগান্তি ডেকে আনবে। 

এডিস নিয়ন্ত্রণে যেমন অবহেলা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে জটিল করেছে, তেমনি কিউলেক্স মোকাবিলায়ও অবহেলা করলে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। তাই মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত, পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ সময়ের দাবিই নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।  

মো. মোজাম্মেল হক

কীটতত্ববিদ

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)

এসএইচ