জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে উপকূলের কৃষি জমি। দেশের মোট আয়তনের ৩ ভাগের ১ ভাগ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। যা আয়তনের হিসেবে ৪৭ হাজার ২০১ বর্গ কিলোমিটার। গবেষকদের তথ্য অনুসারে, উপকূলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে ৬ থেকে ৭ মাস পতিত থাকে। তবে, লবণাক্ততা ও সেচের পানির অভাবে চাষ হচ্ছে না এসব জমি। এসব জমিতে বছরে ১ বার, বর্ষাকালে আমন ধান উৎপাদিত হয়।
৭ বছর গবেষণার পর চূড়ান্তভাবে লবণাক্ত পানিতে চাষাবাদে সাফল্য পান গবেষকরা। ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম এই গবেষণায় সম্পৃক্ত আছেন। তাদের সাথে আছে বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী বলেন, 'ধান কাটার পর গম উৎপাদন করতে গেলে শীত পাবে না। সেজন্য গমের ফসল ভালো হচ্ছে না। সেজন্য আমি রিলে পদ্ধতিতে চাষ করছি। এতে সঠিক সময় মধ্য নভেম্বরে বীজ রোপন শেষ করতে পারবো।'
উপকূলীয় এলাকায় গম বোনার উপযুক্ত সময় নভেম্বর। তবে উপকূলের জমিতে নভেম্বরে আমন ধান থাকে। যা কাটা হয় ডিসেম্বরে। এ কারনে জমিতে আমন ধান থাকা অবস্থায় মধ্য নভেম্বরে গম বীজ ছিটানো হয়। এটাই গম চাষের রিলে পদ্ধতি। রিলে নামের এই চাষাবাদ পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ৪০৬ কেজি গম উৎপাদন হয়, যেখানে সাধারন পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় উৎপাদন হয় ২৭৭ কেজি। রিলে পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচও অনেকটা কম।
ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী আরও বলেন, 'ইকোনোমিক্যালি এনালাইসিস করে মাত্র বিঘাপ্রতি ৫ হাজার টাকা খরচ করলে আমরা ১০ মণ গম পাই। প্রতি জমি থেকে কৃষকরা যদি ১০ হাজার টাকাও পায় তাহলে এই এলাকার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে।'
বরগুনার তালতলি উপজেলার নল্বুনীয়া গ্রামের জমিতে বছরে শুধু একবারই ফসল হতো। বাকী সময়টা থাকতো অনাবাদি। তবে এবার গ্রামে ভিন্ন চিত্র। গ্রামের ২০ জন কৃষক প্রথম বারের মত ৭ একর জমিতে স্বল্পমেয়াদি 'বারি গম ৩০' এর আবাদ করেন। প্রতি বিঘা জমিতে ১০ মণ করে গম উৎপাদন হয়েছে।
একজন কৃষক বলেন, '২০০৭ সালের সিডরে লবন ঢোকার পর একটা ফসলের পর আর কোনো ফসল আমরা দেই না। ধানের ফলন ভালো হয় না লবনের কারণে। সেজন্য আমরা আবার গম চাষ করা শুরু করছি। উৎপাদন ভালো হইছে। আমরা প্রতি বছর এখন গম চাষ করবো।
দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পতিত জমিগুলোকে আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গম হচ্ছে এমন একটি ফসল যা প্রাকৃতিক ভাবেই লবন সহিষ্ণু। বিজ্ঞানীরা মনে করেন উপকূলের লবণাক্ত জমিতে গম চাষই উপযুক্ত। তারা আরও মনে করেন উপকুলের এই লবনাক্ত জমিগুলোকে যথাযথভাবে গম চাষে ব্যবহার করা গেলে বাড়বে গমের সামগ্রিক উৎপাদন। এই পদ্ধতিতে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করবে কৃষি অধিদপ্তর।
বরগুনা খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বলেন, 'কৃষকরা যখন দেখে যে এই প্রযুক্তিটা ভালো। আমরা প্রথমে পরীক্ষা করার পরপরই কৃসকদের মাঝে এ চাষ করার জন্য উৎসাহ দিতে থাকি।'
প্রতি বছর গম আমদানীতে ব্যয় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় গমের উৎপাদন বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর বদিউজ্জামান।
তিনি বলেন, 'যদি গম দিয়ে আমরা দক্ষিণ অঞ্চলকে ভরপুর করতে পারি তাহলে এই খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা সরবারহ করতে পারবো। একইসাথে এটা রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারবো।'
উপকূলের বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে 'বারি গম ৩০' আবাদে এক ফসলি জমি ২ ফসলি হবে। এই গম আবাদ জোরদারে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান স্থানীয় সংসদ সদস্য।
বরগুনা ১ এর সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, 'গমের চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের অভ্যাস পবির্তন হচ্ছে। গম উৎপাদনে আমরা বেশি প্রণোদনা দেবো। আমি জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে কথা বলবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুষ্টি আকর্ষণ করবো।'
গমে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন থাকে। গম দিয়ে আটা-ময়দা ও সুজি তৈরি হয়। আর এগুলো দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের মুখরোচক খাবার। ধানের পর গমই হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। গমের উৎপাদন বাড়ানো গেলে খাদ্যের পরনির্ভরশীলতা কমবে। এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।