দেশে এখন
0

হেমন্তে প্রকৃতির আলিঙ্গন ও নবান্নের খোলা চিঠি

হেমন্তের সঙ্গে নবান্নের সখ্যতায় দেখা দিয়েছে ফাটল। গ্রামে গ্রামে পাকা ধানের ম-ম গন্ধে কৃষকের ঋণ শোধের দুশ্চিন্তা। বিটুমিনের দখলে গিয়েছে মেঠোপথ। গ্রামে নগরের জৌলুস। নবান্নের উৎসবে বিষণ্ণতা। তবুও নবান্নের স্মরণে এখনো স্মৃতির মানসপটে উঁকি দেয় হেমন্তের সোনালী অতীত, পীড়া দেয় অগোছালো বর্তমান আর দুশ্চিন্তার খোরাক হয় হেমন্তের অন্ধকার ভবিষ্যত।

নবান্নের খোলা চিঠি

প্রিয় হৈমন্তী! বাড়ন্ত লাউয়ের ডগার কাঁচা সবুজে ভেসে বেড়ায় তোমার কৈশোর। মাকড়সার পাতা জালে চিকচিক করা শিশিরবিন্দু যেনো তোমার যৌবনের বরণ ডালা। বিস্তৃত মাঠজুড়ে সোনালী ধানের পাতায় মেহেদীর আলপনার যে আয়োজন, তার পুরোটাই তোমার সমীপে।

হৈমন্তী, তোমার শরীরজুড়ে নবান্নের যে ঘ্রাণ তা আজ ম্রিয়মাণ। যাদের জন্য নবান্নের চিরায়ত আয়োজন তারা আজ বাঁচে শহুরে রঙের আবরণে। কোনো এক বিকেলে পড়ন্ত সূর্য সাক্ষী রেখে ইঞ্জিন চালিত বাহনে যারা ছেড়েছে শেকড়ের গান, জীবিকার পিছুটান পল্লী বালার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে যে প্রজন্মকে। নবান্ন যেন তাদের হৃদয়ে আজও কাঁদে একান্ত নিভৃতে।

হে কুয়াশার প্রবেশপথ, রবীন্দ্রনাথ এক ছোটগল্পে তোমাকে সম্বোধন করেছিল অকলঙ্ক শুভ্র, নিবিড় পবিত্র। তারও বহুকাল আগেও বেকার প্রেমিক, বখাটে ভবঘুরে, নিপীড়িত কৃষক, বোকাসোকা তরুণ, কে পড়েনি তোমার প্রেমে! অথচ তুমি কি-না মরা কার্তিকেই মিশে যাও ঘন কুয়াশার গহ্বরে। আবার তুমিই বড় বিচিত্রভঙ্গিতে তোমার রঙে রঙিন হওয়া ধান, ফসলের মাঠ, অগ্রহায়ণের সবুজ সবজি, নিলাভ আকাশ সাক্ষী রেখে করো পাতা ঝরার উদ্বোধন।

শিক্ষক ও গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন  ‘গ্রাম বাংলায় আগে সারা বছরের খাবার থাকত না, ফসল উঠানোর আগ দিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে একধরণের উদ্দীপনা তৈরি হতো এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ প্রথা মেনে সৃষ্টাকে স্মরণ করে একটা উৎসবের যাত্রা শুরু করত। এ সময়ে নানা রকমের পিঠা পায়েস বানানো হত।’

হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে জীবনানন্দ দাশ ফিরতে চেয়েছিলেন এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। এককালে নবান্নের সঙ্গে হেমন্তের বন্ধন আষ্টেপৃষ্ঠে থাকলেও ক্রমশ বাড়ছে দূরত্ব। উনুনে উঠছে না নতুন ধানের ঢেঁকি ছাটা আটার পিঠা, খেজুর গুড়ের মিশেল হচ্ছে না বাহারি পদের মিষ্টান্ন। ধান কাটার পর নয়া জামাই বরণে প্রস্তুত হচ্ছে না কলাপাতার তোরণ। অথচ তোমার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুরতার খেলা, ভেঙে চুরে দিচ্ছে প্রকৃতির ভেতর বাহির। বোবা কান্নায় মুষড়ে পড়ছে জৌলুষময় অতীত আর অগোছালো বর্তমান।

সমাজকর্মী মো. মশিউর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘একটা বছরে কয়টা ঋতু পার হয়ে যায়, এই অভিজ্ঞতাটাই আমাদের থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমান যুগের মানুষেরা ষড়ঋতু কী তা বোঝে না।’

হে হেমন্তীকা, হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।' বিশ্বকবির কলমে তোমাকে নিয়ে এমন আকুলতাই বলে দেয় তোমার সঙ্গে দূরত্ব যতই হোক, তুমি আছ খুব কাছে। ধানের পাতায় শিশিরবিন্দু হয়ে, কিংবা হয়ে শীতের আগমনী গান। তোমার সমীপে নিবেদন, ফের প্রেয়সী হও অনাগত প্রজন্মের প্রতিটি প্রাণে।

এএম