দেশে এখন
0

গণতান্ত্রিক দেশ গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান ড. ইউনূসের

জাতিসংঘে বাংলায় দেয়া ভাষণে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানালেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শক্তিশালী অর্থনীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই অন্তর্বর্তী সরকারের এ মুহূর্তের মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি। টেকসই সংস্কার ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের কাজ চলছে বলেও বিশ্বনেতাদের অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া বিশ্ব দরবারে তুলে ধরলেন জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের তরুণদের বীরত্বগাঁথা।

বিশ্ব জাতিগোষ্ঠীর সভায় লাল সবুজের প্রতিনিধি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত নোবেল বিজয়ী ইউনূস এবার সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বমঞ্চে উঠেছেন।

শুরুতেই জুলাই বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের গল্প তুলে ধরেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে দেশকে মুক্তি দিয়েছে। যা বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তি ও ন্যায় বিচারের প্রেরণা।

ড. ইউনূস বলেন, 'সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ এক নায়কতন্ত্র নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের ছাত্র-জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। আমাদের জনগণ একটা ন্যায্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছে। আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছে। বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগাবে।'

আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, দলীয়করণ, অর্থ লোপাট ও দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারসহ নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, 'সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মমভাবে দলীয়করণের আবর্তে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কীভাবে জনগণের অর্থ লুটপাট করা হয়েছিল। কীভাবে একটা দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দেশের বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষীগতভাবে দেশের সম্পদকে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটা প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই ,মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।'

নির্মম অতীত যেন আর ফিরে না আসে সেজন্য রাষ্ট্র সংস্কার করে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়া হবে বলে জানান ড. ইউনূস। বলেন, ন্যায় ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা হবে।

ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, এটাই জাতির আকাঙ্ক্ষা। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভিষ্ট। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।'

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমানোর পাশাপাশি অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিনিয়োগের আহ্বান জানান ড. ইউনূস। কৃষি, পানি ও জনস্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

বিশ্ব নেতাদের সামনে শূন্য দারিদ্র, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, এই তিন শূন্যের পৃথিবীর ধারণা দেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী। তার সামাজিক ব্যবসার এই ধারণা বিশ্বব্যাপী সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে মনোযোগী হবে।

ভাষণে, ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানান ড. ইউনূস বলেন, দ্বি রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারে। এসময় রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়পক্ষকে সংলাপে বসে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতা বিরোধী অপরাধ হচ্ছে। তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সাথে করা যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখাচ্ছে তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বি রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারে। তাই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।'

রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রত্যাশা করেন বাংলাদেশ সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, 'আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার উদ্দেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।'

উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণ ব্যতীত শান্তি ও নিরাপত্তা সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।

ড. ইউনূস বলেন, 'বাংলাদেশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নারী পুরুষ সকলের জন্য আগামীর দিনগুলোতে উদ্যোক্তা হবার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।'

জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সমূহ শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকার প্রমাণ করেছে বলে জানান ড. ইউনূস। ভবিষ্যতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর।

সরকারপ্রধান বলেন, 'সাম্প্রতিক বিপ্লবকালে আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিনতর সময়ে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের সাহসী সশস্ত্রবাহিনীগুলো আরও একবার শান্তি প্রতি তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করেছে।'

শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সকলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান বাংলাদেশ সরকার প্রধান।

এসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর