দেশে এখন
0

এক ব্যক্তির শাসনে সবই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে: আলী রীয়াজ

বিশেষ সাক্ষাৎকার

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী শাসনামলের পতন ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের হাল ধরেছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। আপাতত চলছে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। এই সংস্কারের আলোচনার সঙ্গে দাবি উঠেছে সংবিধান পুনর্লিখনের। এবার প্রশ্ন উঠেছে- যেখানে সংশোধনের সুযোগ আছে, সেখানে পুনর্লিখন কেন? তার প্রক্রিয়াইবা কেমন হবে! এসব বিষয় নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকারে ‘এখন টিভি’র মুখোমুখি হয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো। সবশেষ আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এই অধ্যাপক।

কেন সংবিধান পুনর্লিখনের প্রশ্ন আসছে?

বিরাজমান সংবিধানের মধ্যদিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ। তবে সংবিধানের এক তৃতীয়াংশতে হাত দেয়ার জায়গা নেই। বলা হয়েছে সংবিধানের এ অংশগুলোকে সংশোধন করা যাবে না। এই অংশ সংশোধন না করে বাকি অংশ সংশোধন করে লাভ নেই। যেকোনো সংবিধান জাতির আকাঙ্ক্ষার দলিল। ’৫২ সালে আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন হয়েছে। ’২৪ সালে নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।

গণঅভ্যত্থান বা গণবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্রের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তাকে ধারণ করে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে অনেকগুলো জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজের সঙ্গে কথোপকথনে এখন টিভির প্রতিবেদক।

পুনর্লিখন কেন বলছি, কারণ আগের সংবিধানের অনেকগুলো দিক আছে সেগুলো রাখা দরকার। বাকি যে অংশগুলো গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করে না, অধিকার সংরক্ষণ করে না, প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করে না বরং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে- সেগুলোকে নতুন করে লিখতে হবে।

এক্ষেত্রে যে তিনটি পথ রয়েছে-

প্রথমত, একটি সংবিধান সভা তৈরি করা যেতে পারে, গণপরিষদ গঠন করে। তারা সংবিধানের একটি খসড়া করবে। পরে তা গণভোটে দিয়ে পাস করাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এই সরকার সকলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে একটা খসড়া তৈরি করতে পারে। সকলের মানে সব রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, আইনজীবীরা মিলে এই খসড়া তৈরি করতে পারে।

তৃতীয়ত, কনস্টিটিউশন কনভেনশন: সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে আলাপ আলোচনা করে সেখানে একটি সংবিধান তৈরি করে, সেই খসড়া সংবিধান গণভোটে দেয়া।

বারবার গণভোটের কথা আসছে এই কারণে যে, সংবিধান হচ্ছে জনগণের দলিল। জনগণের সমর্থন নিয়েই এটি প্রণয়ন করতে হবে। তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে কীনা তা দেখতে হবে।

সংসদ: যে সংসদ আপনি তৈরি করতে পারবেন এই সংবিধান দিয়ে, সেই সংসদ যে কী হয়- সেটা আমরা গেল ১৫ বছর ধরে দেখেছি। এই সংসদ বা সংবিধান দিয়ে আপনি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারবেন না। সে কারণে আমরা বলেছি সংবিধান পুনর্লিখন হোক। অবশ্যই গণভোট করতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষ যাতে বলতে পারেন, এটা তারা মানেন কীনা।

৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের যে বাধ্যবাধকতা সেটি নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। কেউ আবার এও বলছেন যে, এ সরকার বৈধ কীনা? এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন, সরকার কি বৈধ?

এ সরকারের বৈধতা কিন্তু আদালত কিংবা সংবিধানের একপাতা কাগজের মতো নয়। এ সরকারের বৈধতা হয়েছে গণমানুষের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

সংসদ ভবন। ছবি: সংগৃহীত

১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের যে গণঅভ্যুত্থান, ৮শ'র বেশি মানুষের যে মৃত্যু, ১৮ হাজারের বেশি আহত। এই সরকারের বৈধতার প্রশ্ন এখন যারা তুলছেন- তারা এ দেশের মানুষের গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।

যে সংবিধানের কথা তারা বলেন, সেই সংবিধান শেখ হাসিনার মতো একটা স্বৈরাচার তৈরি করেছে। তারা সেটাকে অস্বীকার না করে এখন সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে একথা সংবিধানে নেই। এরকম একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কথাই নেই। ফলে বৈধতার কথা যারা বলছেন, তারা মূলত পরোক্ষভাবে একটা পরাজিত স্বৈরাচারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একধরনের অযুহাত দিচ্ছেন। তারা আসলে মানুষের রক্তের সঙ্গে নির্যাতন নিপীড়নের যে ইতিহাস তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।

কিন্তু বর্তমান সরকারও তো এই সংবিধান অনুসরণ করছে-

তারা ততটুকু অনুসরণ করছেন, যতটুকু তার দরকার হয়েছে শপথ গ্রহণের জন্য। কারণ আপনি সংবিধানের পাতা গুণতে শুরু করেন, দেখবেন এরকম অন্তর্বতী সরকারের কোনো বিধানই নেই সংবিধানে। এখন যেটা দাঁড়াচ্ছে সেটা হচ্ছে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। এই অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা কোনো না কোনো সময়ে সংবিধানের মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে এবং সেটা করানোর জন্যই পুনর্লিখন প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ পাঠ। ছবি: সংগৃহীত

যখন পুনর্লিখিত সংবিধান কার্যকর হবে, তখন আগের সংবিধান আপনা আপনি বাতিল হয়ে যাবে বা স্থগিত হয়ে যাবে। এখন যারা এই সংবিধানের দোহাই বা অযুহাত দিচ্ছেন- এগুলোকে কূটতর্ক ছাড়া আর কিছু মনে করিনা। এবং এই কূটতর্কগুলো আসলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। আসুন, আমরা তার চেয়ে বিবেচনা করি এই অন্তর্বর্তী সরকার স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্র বিলোপ করার বন্দোবস্ত করতে পারে কীনা!

সরকার কী আন্তরিক? পুনর্গঠন কতটা জরুরি? কতটা আন্তরিক দেখছেন?

প্রথম কথা, এ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৩১ দিন হলো। তাকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে এ সরকারকে বিপদগ্রস্ত করার অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। দেশের ভেতরে হচ্ছে, দেশের বাইরে হচ্ছে- এগুলো তাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আশু যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো তারা মোকাবিলা করছেন। ফলে এই ৩১ দিনের মধ্যে তারা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন না বলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।

তারা বলেছেন যে, তারা একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চান, স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্র বিলোপ করতে চান। এটাকে তারা সংস্কার বলছেন। আমি বলছি, সংবিধান পুনর্লিখন। তারা এখনই বলছেন না, আমি আশা করি তারা বলবেন। তারা বলছেন না, এটি আবার একেবারে ঠিক না। কারণ অন্ততপক্ষে যে ছাত্ররা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কিন্তু বলছেন যে, তারা চান এরকম একটা নতুন বন্দোবস্ত। ফলে এখনই যে বলা হচ্ছে সরকার বলছে না, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

অন্যদিকে আমরা বা আমি যেটা বলছি, আমার দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই আলোচনাটা সবার করতে হবে। সবাই করলে তারই একটা প্রতিফল হয়তো আমরা দেখতে পারি।

এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। কারণ রাজনীতি তো রাজনৈতিক দলগুলোই করবে। অন্তর্বর্তী সরকার তো অন্তর্বর্তী সরকারই, দেশ শাসন তো শেষপর্যন্ত রাজনীতিকরাই করবেন। নতুন পুরাতন সবগুলো রাজনৈতিক দল মিলেই তো করবে। রাজনীতিই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ রূপরেখা। আপনি যদি খেয়াল করেন, এর জন্য কিন্তু আমি তিনটি উপায়ের কথা বলেছি। সেটা হলো- প্রথমত, হয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি। দ্বিতীয়ত, কনস্টিটিউশন কনভেনশন এবং তৃতীয়ত, আলোচনার মাধ্যমে খসড়া তৈরি এবং পরে গণভোটে ব্যবস্থা।

এখন এই আলোচনাটা সমাজে তৈরি হয়েছে। ধরুন, সাতদিন আগেও তো এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম না, এখন তো করছি। তাহলে এক সময় রাজনৈতিক দলগুলোও যুক্ত হবেন এ আলোচনায়। তারাও নিশ্চয়ই বিবেচনা করছেন। তারাও তো বলছেন, ভবিষ্যতে এরকম স্বৈরতন্ত্রের পথ বন্ধ করতে চান।

ফলে তাদেরও নিশ্চয়ই কোনো না কোন প্রস্তাব থাকবে। আলোচনাটা শুরু হয়েছে। তারা যুক্ত হবেন। আপনি গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আলোচনা করছেন। আমি আমার সীমিত বিবেচনার থেকে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি। প্রস্তাব আকারে হাজির করেছি। তারপর আলোচনাটা হচ্ছে। আলোচনা হবে। একটা বড় সময় পার হয়ে গেছে তা তো নয়, মাত্র ৩১ দিন হয়েছে এ সরকারের।

সংশোধনের কথা কেন বলছি না, পুনর্লিখনের কথা কেন বলছি?

সামান্য এদিক-সেদিক সংশোধন করে মূল যে লক্ষ্য, মূল যে প্রয়োজন সেটা অর্জন করা যাবে না। আপনি যেগুলো দেখছেন, যেগুলোকে আপনারা সংস্কার বলছেন। আমি এগুলোকে এখনো সংস্কার বলিনা। কারণ সংস্কার শব্দটা এত ব্যবহৃত হয়েছে আসলে সেটার মর্মটাই শেষ হয়ে গেছে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধান। ছবি: সংগৃহীত

এক ব্যক্তির শাসনে সবই তো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। এখন যে আপনি অর্ডিন্যান্সের কথা বলছেন, সাময়িক ব্যবস্থার কথা বলছেন, এগুলো হচ্ছে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য যা যা দরকার সেগুলোই তারা করছেন। এগুলোকে আপনি স্থায়ী ব্যবস্থা মনে করতে পারেন না। কারণ নতুন সরকার বা যখন নির্বাচিত সরকার আসবে, পরদিনই এগুলো সহজেই বাতিল করে দিতে পারবে। ফলে এগুলো স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। এগুলো এ মুহূর্তে সরকার পরিচালনায় যা যা দরকার, সেরকম কিছু পদক্ষেপ। 

যদি পুনর্লিখন না হয়, তখন কী হতে পারে?

দেখুন প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এর বিপরীতে এক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা হয়েছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পথ আসলে এই সংবিধানকে রেখে নয়। আমি মনে করি যদি সংবিধানের পুনর্লিখন না হয়, এই ব্যবস্থা না করা যায়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং দেশের স্বৈরাচার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে না। জবাবদিহিতার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করা, যে সমস্ত স্টাটিউটরি বডি আছে, সেগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, তার নিশ্চয়তা বিধান যদি না করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ আগের মতো কিংবা আরো ভয়াবহ স্বৈরাচারের কবলে পড়বে।

ইএ