সবুজ পরিচ্ছন্ন নগরীতে শেষ কবে রাজনৈতিক নৈরাজ্যে বারুদের গন্ধ শুঁকছে রাজশাহী! সংখ্যাগুরুর দাপটে কবে নুয়ে পড়েছে সংখ্যালঘুর কাঁধ! শান্তির এ নগরে ইতিহাসের পাতা বলে, তা ছিল বহুদূরের অতীত।
তবে, ৫ আগস্ট, শান্ত রাজশাহীর শহরতলি ছাড়িয়ে গ্রাম, বরেন্দ্রজুড়ে জুজুর ভয় তাড়া করে ফিরছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমকুড়ি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা। তবে, ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে দুর্বৃত্তরা লুটেছে গবাদিপশু, টাকা আর বর্গা দেয়া সম্পত্তি।
স্থানীয় একজন বলেন, 'বিভিন্ন বাসভবন হিন্দু এলাকায় যতগুলো আছে, এখানে এখনও কোনো অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। এখানে হিন্দু, মুসলিম সবাই মিলে একটা কমিটি করার পর আমরা প্রতিনিয়ত রাত করে এখানে পাহারা দেই। এখানে কোনো সমস্যা নেই, আর হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।'
বিচ্ছিন্ন এ ঘটনা ছাড়া বরেন্দ্রর সব গ্রামে সুরক্ষিত আছে সংখ্যালঘুদের মন্দিরগুলো। শঙ্কামুক্ত দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলির শ্রী-পার্ট খেতুরি ধাম। শঙ্কটকালীন এ অঞ্চলের সবচেয়ে আদি ধর্মালয়টির সুরক্ষায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জোট বাঁধে গ্রামবাসীরা। তাতে যেকোনো শঙ্কা ভুলে নির্বিঘ্নে পুঁজা-অর্চনা করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
রাজশাহী শ্রী-পার্ট খেতুরী ধামের ব্যবস্থাপক শ্রী গোবিন্দ চন্দ্রপাল বলেন, 'বাংলাদেশের সম্প্রীতির বন্ধনের বহির্প্রকাশ এখান থেকেই ঘটে। এখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে এটান আমরা আশঙ্কাই করিনি এবং ঘটেওনি। এলাকার সকল স্তরের মানুষ আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছে।'
এছাড়াও, কসমোপলিটন শহর রাজশাহীর হড়গ্রাম, শ্রী-রামপুর, আলুপট্টি, ঘোড়ামারা এলাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। এ নগরে ৪৭টি মন্দিরের কোনোটিতেই সংঘাতের খবর নেই। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায়, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মন্দিরগুলোকে পাহারা দিয়েছেন মহল্লাবাসী, সাথে যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী মহানগর ধর্মসভার সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী-বিকাশ কুমার সরকার বলেন, 'যতটুকু জায়গা দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে কোনো সমস্যা নেই। কোনো মন্দির আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।'
তবে, রাজশাহী বিভাগের অন্য জেলাতে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে নাটোর শহরের উত্তর পটুয়াপাড়ায় ও লালপুরে লুট হয় হিন্দু নেতাদের বাড়িঘর। পাশাপাশি জোত-দৈবকী শিব ও কালীমন্দিরের সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
নাটোর জেলা শাখার হিন্দু মহাজোটের সদস্য সচিব দেবাশীষ কুমার সরদারা বলেন, 'জনরোষে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং যেসব হিন্দু নেতারা আছে তাদের বাড়িও জ্বালাও, পোড়াও ও ভাঙচুর হয়েছে। আসলে এটা সাম্প্রদায়িক হামলা বলা চলে না। এটা রাজনৈতিক হামলা।'
হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও ঘরবাড়িতে ভাঙচুর আতঙ্ক থাকলেও পাবনাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মন্দিরগুলোতে পালাক্রমে পাহারা দিতে দেখা গেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। আর জেলার ৫৩টি মন্দির ও উপাসনালয়ে প্রার্থনাসহ সকল কার্যক্রম চলছে স্বাভাবিক নিয়মেই।
রাজশাহী বিভাগের আরেক জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। তবুও, কিছুটা ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে। তাতে পাশে দাঁড়িয়েছেন এলাকাবাসীরা। ফলে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে তাদের মাঝে। এ জেলায় মোট ৪৭৪টি মন্দিরের নিরাপত্তা দিতে দল গঠনের পরিকল্পনা করেছেন তারা।
তবে, সংখ্যালঘু হওয়ায় শঙ্কিত অনেকেই, তাদের আশ্বস্ত করতে গ্রাম বা শহরে সক্রিয় অবস্থায় প্রশাসনের পাশাপাশি সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো. শামিম আহমেদ বলেন, 'গোদাগাড়িতে যে মন্দির রয়েছে তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরের ৩ তারিখে ভারত থেকে এখানে অনেক পূর্ণার্থী এখানে আসে। সে বিষয়টি পুলিশ, সেনাবাহিনী সবাই দেখেছে। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, আপনাদের ছাত্র প্রতিনিধিদের দিয়েও যেন এ মন্দিরগুলো দেখা হয়।'
রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলায় গুরুত্বপূর্ণ ২২৫টি মন্দিরসহ অন্যান্য মন্দিরে যেকোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছেন।
৫ আগস্ট রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় নানা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে, এ অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক সে আবেগের এতটুকু আঁচ লাগতে দেয়নি এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। সে সময় এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানোর জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই এসেছিলেন এটি রক্ষার জন্য। যার কারণে রাজশাহীতে প্রত্যেকটি ধর্ম প্রতিষ্ঠানে অক্ষত এবং শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করছে।