বান্দরবানের নয়নাভিরাম বিস্তৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত বান্দরবানে পবিত্র ঈদ উপলক্ষে টানা লম্বা ছুটির কারণে এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদভারে মুখরিত সবুজে ঘেরা অপরূপা বান্দরবানে নানা অঞ্চলের মানুষের পদচারণায় অন্যরকম এক আমেজ বিরাজ করছে।
পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। এ জেলায় রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বিজয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেউক্রাডংসহ অসংখ্য পাহাড়। রয়েছে বাংলার দার্জিলিংখ্যাত চিম্বুক, নীলগিরি, যেখানে অনায়াসে মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
এছাড়াও রিঝুক ঝরনা নিজস্ব গতিতে সব মৌসুমেই থাকে সচল। এছাড়া জেলা সদরেই রয়েছে মেঘলা, নীলাচল, প্রান্তিক লেক, স্বর্ণ জাদি (যা লোকমুখে স্বর্ণ মন্দির হিসেবে অধিক পরিচিত) যা না দেখলে সৌন্দর্য দেখা অপূর্ণ থেকে যাবে বলে মনে করেন অনেকে।
নীলাচলে দাঁড়ালে পাহাড় আর আকাশের মিতালী, দূরে সবুজ বন কিংবা চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য আবছা আবছা উপভোগ করা যায়। পাহাড় থেকে শহরের সৌন্দর্য বিমোহিত করে পর্যটকদের। বৌদ্ধ ধাতু জাদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হলেও পাহাড়ের উপর সুন্দর কারুকার্য ও স্বর্ণাভরণে তৈরি হওয়ায় এটিও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে।

প্রান্তিক লেক, বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের পাশে হলুদিয়া নামক স্থানে অবস্থিত। মূল সড়ক থেকে এর দুরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। জেলা সদর থেকে 'প্রান্তিক লেক' এর দুরত্ব ১৪ কিলোমিটার। লেকটিতে উম্মুক্ত মাটির মঞ্চ, পিকনিক স্পট, বিশ্রামাগার এবং একটি উঁচু গোল ঘর ইত্যাদি স্থাপনা রয়েছে। গোল ঘরে বসে লেকের সৌন্দর্য সহজে উপভোগ করা যায়। প্রায় ২৫ একর জায়গাজুড়ে সৃষ্ট কৃত্রিম জলাশয় 'প্রান্তিক লেক' এর জলাভূমির আয়তন ২৫ একর হলেও পুরো কমপ্লেক্সটি আরও অনেক বড়। অপূর্ব সুন্দর এ লেকের চারিপাশ নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে ভরপুর।
বান্দরবান চিম্বুক সড়কের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে শৈলপ্রপাত ঝরণা। বান্দরবান-থানচি সড়কের ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পর্বতচূড়া চিম্বুক পাহাড়। একই সড়কে ৫০ কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠেছে বাংলার দার্জিলিংখ্যাত নীলগিরি। সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত নীলগিরিতে দাঁড়ালে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দেশের অভ্যন্তর থেকে উৎপত্তিকৃত সাঙ্গু নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বিজয়, এটি তাজিংডং নামেই পরিচিত। রুমা উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করে যেতে হয় তাজিংডং পাহাড়ে, পাশেই রয়েছে দেশের দ্বিতীয় পর্বতচূড়া কেউক্রাডং পাহাড়। এছাড়া একই সড়কে ১৭ কিলোমিটার গেলে দেখা যায়। কিংবদন্তী বগালেক এটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্পট।
নাফাখুম জলপ্রপাত বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত। পানি প্রবাহের পরিমাণের দিক থেকে এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। নাফাখুম দেখতে থানচি বাজার থেকে সাঙ্গু নদী পথে নৌকা দিয়ে তিন্দু বড়পাথর হয়ে রেমাক্রি যেতে হয়। রেমাক্রী খালের পানি নাফাখুমে এসে বাক খেয়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট নিচের দিকে নেমে গিয়ে প্রকৃতি জন্ম দিয়েছে এই জলপ্রপাতের।

এছাড়া বান্দরবান সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দুরুত্বে রোয়াংছড়ি উপজেলায় রয়েছে দেবতাখুম। দেবতাখুম মুলত একটি খালের আগা, যার দুই পাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এবং গভির পানির পাথুরে জায়গা। বান্দরবানে যতো খুম আছে তার মধ্যে দেবতাখুম হচ্ছে সবার প্রিয় একটি জায়গা।
এছাড়াও এই জেলায় মারমা, ত্রিপুরা, মুরুং, বম,তঞ্চঙ্গ্যা, খুমি, খেয়াং, পাংখোয়া, চাকমা, চাক, লুসাই, বাঙ্গালীসহ ১২টি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে। দেশের অন্য কোনো জেলায় এত আদিবাসীর বসতি নেই।
আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনচিত্র মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে তোলে। বান্দরবানে রয়েছে পাহাড়ের পর পাহাড়, দিগন্তজোড়া আকাশের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ী সমুদ্রের। বান্দরবানে যেদিকে চোখ যায় দেখা মিলবে এ পাহাড়ী সমুদ্রের। তাই বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর ঈদ বা পর্যটন মৌসুমে পর্যটকদের ভিড় পড়ে যায়।
হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দীন বলেন, 'দেবতাখুমসহ পর্যটন স্পর্টগুলো খুলে দেয়ায় এবারের ঈদে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অনেক আগে থেকেই হোটেল-মোটেলগুলো বুকিং দিয়ে রেখেছেন পর্যটকরা। পরিস্থিতি অনুকুলে থাকলে প্রতিবছর ঈদের মৌসুমে বান্দরবানে কয়েক হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। দেবতাখুমের মতো রুমা-থানচি উপজেলার বগালেক, কেউক্রাডং, তিন্দু, বড় পাথর, রেমাক্রী, নাফাখুমসহ পর্যটন স্পটগুলো খুলে দিলে আগামী ঈদুল আজহাতে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে।'
ট্যুরিষ্ট পুলিশের বান্দরবান জোনের ওসি সৈকত কুমার রায় বলেন, নীলাচল, মেঘলা, প্রান্তিক লেক, শৈল প্রপাত, দেবতাখুমসহ পর্যটন স্পটগুলোতে যাতে পর্যটকরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে তাদের নিরাপত্তায় ট্যুরিষ্ট পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে টহল অব্যহত রেখেছেন।'
জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, 'পর্যটকবান্ধব বান্দরবানে পর্যটক আসবে এটাই স্বাভাবিক, আমাদের যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো আছে সেখানে ট্যুরিষ্ট পুলিশ অবস্থান নিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সে নির্দেশনা আমাদের রয়েছে। বান্দরবানে যে পরিবহন মালিক সমিতিগুলো আছে তারা যাতে পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করে সে ব্যপারে আমাদের নির্দেশনাসহ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত আছে।'
তিনি বলেন, 'বান্দরবানে যে তিনটি উপজেলায় পর্যটকদের যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা ছিল তার মধ্যে একটি উপজেলার পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ দেবতাখুম তা রমজানের আগেই খুলে দেয়া হয়েছে, এটিকে কেন্দ্র করে এবারের ঈদে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।'