রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ যাদের ভরসা তাদের একজন আসমা খাতুন। তবে প্রতিদিনই তাকে ব্রিজে উঠতে হয় পা টিপে টিপে, কারণ সিড়িগুলো ভাঙা। তবুও, দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই তাকে পার হতে হয়, না হলে ৩০০ মিটারের মতো পথ পাড়ি দিতে হয় পরের ব্রিজের জন্য।
আসমা খাতুন বলেন, 'একে তো খুব রিস্ক নিয়ে ব্রিজ দিয়ে যাওয়া আসা করি, তার মধ্যে আবার ব্রিজের ওপর দুই পাশে শুয়ে থাকে। এখানে বসেই ওরা নেশা করে। আমাদের যেতে অনেক ডিস্টার্ব করে।'
পরিবাগের ফুটওভার ব্রিজ দেখে যে কারো মনে হতে পারে এটি বোধ হয় আয়ুষ্কাল শেষ করে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু আদতে তা নয়। প্রতিদিনই অসংখ্য পথচারী ব্রিজটির ভাঙা সিড়িগুলোরও ওপর দিয়েই রাস্তা পারাপারা করে থাকেন। এই ব্রিজটি দেখেই স্পষ্ট হওয়া যায় যে, ব্রিজটি দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে পরিচ্ছন্নতা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পড়ে আছে।
পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে এখন ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি বাজেটে, দৃষ্টিনন্দন করে। একেকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের ব্যয় হচ্ছে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা। আর চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত হলে বাজেটে যোগ হয় আরও ১ থেকে দেড় কোটি টাকা।
নির্মাণ ব্যয়ে এত বাজেট রাখা হলেও পরে সঠিকভাবে তদারকি করছে না কর্তৃপক্ষ। করা হয়না নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। যার কারণে অল্পদিনেই সিঁড়িগুলো ক্ষয় হয়ে যায়। সাথে বাড়তি ভোগান্তি যোগ করে সেতুর ওপর ভবঘুরে, মাদকসেবীদের আড্ডা আর ভ্রাম্যমাণ দোকানের পসরা।
একজন পথচারী বলেন, 'এই যে জরাজীর্ণ ভাঙ্গা সিঁড়ি, এটার ভেতর দিয়ে যেতে আমাদের অনেক ভয় করে। এখানে আগে যে পরিবেশ ছিল, সেই পরিবেশ এখন আর নেই।'
সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে রয়েছে ৪৭টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে রয়েছে ৩৫টি ফুটওভার ব্রিজ। আর উত্তর সিটির চারটি ফুটওভার ব্রিজে আছে ৮টি চলন্ত সিঁড়ি।
দেশের প্রথম চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ নির্মিত হয় বনানীতে। নির্মাণকালে বলা হয়েছিল প্রতিদিন সিঁড়ি দুটো চলবে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। থাকবে জেনারেটর ব্যবস্থাও। কিন্তু তেমন একটা সুফল পায়নি নগরবাসী। ব্রিজটির সিঁড়ি দুটো অধিকাংশ সময়ই থাকে অচল হয়ে। দীর্ঘদিন পরিস্কার না করায় জমে আছে ময়লা আবর্জনা।
একজন পথচারী বলেন, 'মাঝখানে একবার শুনেছিলাম যে চালু করবে, কিন্তু পরে আর তা করেনি। আর এই ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে না গেলে সামনের ব্রিজটা এখান থেকে আরও মিনিমাম ৫৪০০ মিটার দূরে আছে। অফিস টাইমে এতো দূর দিয়ে ঘুরে যাওয়া সম্ভব না বলে এটা দিয়েই যাই।'
বিদেশগামী যাত্রী আর বয়স্ক নাগরিকদের চলাচলের সুবিধার্থে বিমানবন্দর স্টেশনেও নির্মিত হয় চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ। সেটিও দীর্ঘদিন ধরে অচল। বছরখানেক আগে আরো একটি চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত ফুটওভার ব্রিজ উদ্বোধন হয় রাজধানীর ইসিবি চত্বরে। অল্প কিছুদিন চলার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটওভার ব্রিজ একটি বিশেষ স্থাপনা। যার রক্ষণাবেক্ষণও করা দরকার বিশেষ পদ্ধতিতে। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলার কারণে, কোটি টাকা ব্যয়ে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করেও তার কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, 'আমরা তৈরি করি, কিন্তু দেখা যায় তা মানসম্মত হয় না। আবার দেখা যায় রক্ষণাবেক্ষণটাও করা হয় না। ফলে খুব দ্রুতই এটা নষ্ট হয়ে যায়। যে সেবা দেয়ার জন্য এটা নির্মাণ করা হয় সেখানে আর কাজে লাগে না। সেজন্য এরকম ব্রিজ করার জন্য অবশ্যই আলাদা করে বাজেট রাখতে হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের ফুটওভার ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণ করা জটিল কাজ। তাই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের আহ্বান তার।
আতিকুল ইসলাম বলেন, 'শুধু ফুটওভার ব্রিজ না। আমি লিফটের জন্য লোক রেখেছি। কিন্তু আমি লিফট যে লাগাবো, এটার দেখাশোনা করবে কে। এলাকাবাসী মেইনটেনেন্স না করলে সিটির জন্য সম্ভব না।'
ফুটওভার ব্রিজের মতো বিশেষ স্থাপনায় সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের দিকে কর্তৃপক্ষের আরও যত্নশীল হওয়ার প্রত্যাশা নগরবাসীর।