বৈশাখের তপ্ত দুপুরে খেটে খাওয়া মানুষের পানিই বড় ভরসা। শহরের বিনামূল্যের উৎস থেকে তাই পানি নেয়ার চেষ্টা রিকশাচালক মো. আব্দুলের। বিশুদ্ধ পানির সংকট ও আয়ের টানাপোড়ার মধ্যে এই সংগ্রহে অতিরিক্ত খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। তাতে অবশ্য বিশুদ্ধতার সঙ্গে আপোষ করতে হচ্ছে।
রিকশাচালক বলেন, ‘পানি ছোট-ছোট দোকানে কিনে খেতে হয়। দিন ১০ থেকে ২০ গ্লাস পানি খেলে ৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই এখান থেকে পানি নিয়ে রাখলে খরচ কমে যায়।’
অন্যদিকে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল গণি পরিবারের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে বাসায় বসিয়েছেন বৈদ্যুতিক পানির ফিল্টার। পরিচালনা খরচ, বিদ্যুৎ খরচ সবমিলিয়ে পানির জন্য হিসাবের বাইরেও তাকে খরচ করতে হচ্ছে।
বিশুদ্ধ পানির জন্য চায়ের দোকানিকেও গুণতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। এক দোকানি বলেন, ‘প্রতিদিন পানির জন্যই ৩০০ টাকা খরচ হয়।’
দেশে এখন নানা মাধ্যমে নানা মোড়কে বিশুদ্ধ পানি বিক্রি হচ্ছে। গ্লাস প্রতি ২ টাকা থেকে ৫০০ গ্রাম বোতলে ২০ টাকা গুণতে হচ্ছে। আর বাসাবাড়িতে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রে খরচ ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। গেলো বছরে শুধু একটি কোম্পানি পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বিক্রি করেছে ২৬৮ কোটি টাকার।
দেশে প্রতিবছর বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা অর্জনের লক্ষ্যে হাজার কোটি খরচ করছে সরকার। কাজ করছে এসডিজি লক্ষ্য পূরণে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা নিশ্চিতে। সেখানে খোদ রাজধানীতেই খরচ প্রায় ১৫শ' কোটি টাকা, যা থেকে পাওয়া যায় ২৭০ কোটি লিটার পানি। এই পানি কিনতে খরচ করলেও সেটা বিশুদ্ধ করতে গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা পয়সা। তবুও পূরণ হচ্ছে না বিশুদ্ধ পানির সংকট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, প্লাস্টিকের বোতলে পানি বাজারজাতকরণের বিষয়ে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ক্ষতি করছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে যখন পানি সংগ্রহের চেষ্টা করা হবে তখন উৎপাদন কিংবা ব্যবহার খরচ তো বাড়বেই।
শুধু যে এই প্রভাব মানুষের আয়-ব্যয়ের ওপর পড়ছে এমন নয়। সরাসরি দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রভাব পড়ছে, যা পানি বিশুদ্ধ করার বদলে অন্য খাতে ব্যয় করা সম্ভব হলে অগ্রগতি হতে পারে অন্যান্য খাতে। স্বাস্থ্য খাতে ৫০০০ কোটি টাকা খরচ হলেও এর ৮৫ শতাংশই হয় পানিবাহিত রোগে ব্যয় হচ্ছে । এমন অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ প্রভাব ফেলছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘আসলে যে খরচগুলো হচ্ছে সেটার প্রয়োজন হতো না। পানির জন্য যে খরচ হচ্ছে সেটা অন্য খাতে ব্যবহার করলে অর্থনীতির উন্নতি হতো। আমি মনে করি, পানি খাতকে ঘিরেই একটি মহাপলিকল্পনা দরকার। তাহলে হয়তো সবাই কম খরচে পানি পাবে।’
২০৩০ সালের মধ্যে শুধু বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত নয় শুধু স্বল্প খরচে প্রাপ্তিতেও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসেবে, আগামী অর্থবছরে ৭৫ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি সেবা পেতে পারে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিনিময়ে, যাতে দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি সুবিধার আওতায় আসবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে ৯.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করলে সুবিধা পাবে শতভাগ মানুষ।