বিশ্বব্যাপী ইংরেজি নববর্ষকে উদযাপন করা হয় নানা রীতি মেনে। এ উৎসবের পরিসরে মেতে ওঠে বাংলাদেশও। বিশ্বজুড়ে উৎসব উদযাপনের ছোঁয়া এসে লাগে বাঙালির মনেও। থার্টি ফাস্ট নাইট ঘিরে শুরু হয় নতুন বছর উদযাপনের উন্মাদনা। আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির আলোকচ্ছটা। রাতের আধারে পটকা, ফানুস আর তারাবাতির ঝলকানিতে প্রকম্পিত হয় আকাশ।
ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপনের এই রীতি হয়ে উঠেছে আতঙ্কের কারণ। গর্ভবতী নারী, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন এই উন্মাদনার অসহায় শিকার।
মানুষ ছাড়াও উৎসবের ডামাডোলে হুমকিতে পড়ে পশুপাখিরা। আতশবাজি আর পটকার বিকট শব্দে ভীত-সন্ত্রস্ত হয় বোবা প্রাণী, অস্থিরতায় ভোগে পাখিরা। ঘটে প্রাণহানির ঘটনাও।
প্রাণী অধিকার কর্মীদের দাবি, প্রাণীকূলের জন্য যে উৎসব হুমকি ডেকে আনে তা বন্ধে নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ। বাড়াতে হবে সচেতনতা। প্রাণিপ্রেমী রাকিবুল হক এমিল বলেন, 'প্রচুর পশুপাখি হতাহত হয়। রোমেও অনেক সংখ্যক পাখি মরে পড়ে ছিল। আমাদের এখানেও ঘটছে, আমরা এদিকে নজর দেই না বলে হয়তো জানিনা। আমরা অসচেতন হয়ে যাচ্ছি।'
আরেক পরিবেশকর্মী নোনা আহমেদ বলেন, 'রাস্তাঘাটের কুকুরগুলোও তখন পালিয়ে যায়। রাতের আতশবাজির আগুন গাছের ওপর পড়ার কারণে পাখিগুলোও মরে পড়ে যায়। পরদিন সকালেই তা দেখা যায়।'
ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপনের রীতি পরিবেশের জন্যও হয়ে উঠেছে মারাত্মক ক্ষতিকর। আতশবাজি পোড়ানোয় বাড়ে নগরের বায়ু দূষণ।
বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস'র একটি গবেষণায় দেখা যায়, থার্টিফাস্ট নাইটকে কেন্দ্র করে গেল ৬ বছরে বায়ুমান সূচক বেড়েছে সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত। ২০১৭-১৮ সালের দিবাগত রাত ৩১ ডিসেম্বর বায়ুমান ছিল ১৯০, যা পহেলা জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫-তে। ২০১৮-১৯ সালে থার্টিফাস্ট নাইটে বায়ুমান বেড়ে হয় ১৯৫ থেকে ২৪০-এ। মাঝে করোনার সময় কিছুটা কমলেও, সবশেষ ২০২২-২৩ সালের থার্টিফাস্ট নাইটে বায়ুমান বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৭ থেকে ২৮৪-তে।
একইভাবে বেড়ে যায় শব্দ দূষণের মাত্রাও। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, রাতের বেলা ৫০ ডেসিবলে সীমাবদ্ধ রাখার নিয়ম কখনোই মানা হয় না ইংবেজি বর্ষবরণ উদযাপনে। শব্দের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ৭০ ডেসিবল। সবশেষ ৬ বছরে ৩১ ডিসেম্বর ঘিরে সর্বোচ্চ ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ছাড়িয়েছে।
পরিবেশকর্মী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, 'সচেতনতার অভাবে গুটিকয়েক মানুষ এটি করে থাকে। পরিবেশ আইনে এই ধরনের শব্দ তৈরি করা নিষেধ।'
থার্টিফাস্ট উদযাপনে গেল কয়েক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ডসহ ঘটেছে নানা দুর্ঘটনা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। তাই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ফানুস, আতশবাজির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি পুলিশের।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, 'ডিএমপির পক্ষ থেকে সার্কুলার করা হয়েছে। যা যা বর্জন করার কথা বলা হয়েছে তা কেউ করছে কিনা সেটা দেখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বে থাকবে।'
লেখক ও গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, 'শহরের মানুষ যদি গ্রামে গিয়ে এই সংস্কৃতিটা দেখতো তাহলে নতুন বছর উদযাপন আরও ব্যঞ্জনাময় হতো। পৃথিবীব্যাপী আমরা এটা দেখাতেও পারতাম।'
নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করে, প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতি না করেই শুরু হোক নতুন বছর। এজন্য সচেতনতা তৈরিতে সবাইকেই এগিয়ে আসার আহ্বান গবেষকদের।
আরও পড়ুন: থার্টি ফার্স্ট উদযাপনে ৫ বছরে ক্ষতি কোটি টাকার বেশি