ব্যাংক হলিডে: কেন ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোতে লেনদেন হয় না?

৩১ ডিসেম্বর দেশজুড়ে ‘ব্যাংক হলিডে’: বন্ধ থাকবে গ্রাহক লেনদেন
৩১ ডিসেম্বর দেশজুড়ে ‘ব্যাংক হলিডে’: বন্ধ থাকবে গ্রাহক লেনদেন | ছবি: এখন টিভি
0

দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর, তবে তার আগেই কাল থমকে যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতি লেনদেনের চাকা! ক্যালেন্ডারের পাতায় আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর—ব্যাংকিং খাতের সেই বহুল আলোচিত ‘ব্যাংক হলিডে’। সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংকগুলো বন্ধ থাকলেও, পর্দার আড়ালে কাল চলবে হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব মেলানোর এক মহাযজ্ঞ। কেন এই দিনে গ্রাহক লেনদেন বন্ধ থাকে, আর আপনার পকেটের টাকা বা জরুরি লেনদেনে এর প্রভাব কী পড়বে? নতুন বছরের আগে আপনার জন্য কোন কোন সেবা খোলা থাকছে, আর কোনগুলো বন্ধ—জেনে নিন আজকের এই প্রতিবেদনে।"

ব্যাংক হলিডে আসলে কী এবং কেন? (What & Why is Bank Holiday)

অনেকেই মনে করেন এটি একটি সাধারণ ছুটির দিন, কিন্তু আদতে এটি ব্যাংকারদের জন্য বছরের ব্যস্ততম দিন। মূলত ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আর্থিক বছর (Financial Year) শেষ হয়। সারা বছরের হাজার হাজার কোটি টাকার আয়-ব্যয়, আমানত ও ঋণের হিসাব মেলাতে এবং বার্ষিক ব্যালেন্স শিট (Annual Balance Sheet) চূড়ান্ত করতে এই দিনটি ব্যবহৃত হয়।

সারাদেশের সব শাখা থেকে আসা হিসাবগুলো একত্রিত করে ‘অ্যানুয়াল ক্লোজিং’ (Annual Closing) সম্পন্ন করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সময়ের প্রয়োজন হয় বলেই এই দিনে গ্রাহকদের সাথে কোনো সরাসরি লেনদেন করা হয় না।

আরও পড়ুন:

ব্যাংক হলিডে: কোন সেবাগুলো বন্ধ থাকবে? (Closed Services)

কাউন্টার লেনদেন: ব্যাংকের কাউন্টারে গিয়ে নগদ টাকা জমা বা উত্তোলন করা যাবে না।

চেক ক্লিয়ারিং: আন্তঃব্যাংক চেক ক্লিয়ারিং বা বিএসিএইচ (BACH) কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।

শেয়ারবাজার: ব্যাংক বন্ধ থাকায় ঢাকা (DSE) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (CSE) কোনো লেনদেন হবে না।

এলসি ও ফরেন এক্সচেঞ্জ: বৈদেশিক বাণিজ্য বা এলসি (LC) সংক্রান্ত কোনো কাজ এই দিনে হবে না।

ব্যাংক হলিডে: সচল থাকবে বিকল্প মাধ্যম (Active Alternative Services)

ব্যাংকের শাখাগুলো সরাসরি লেনদেন না করলেও ডিজিটাল যুগের কল্যাণে গ্রাহকরা বেশ কিছু সুবিধা পাবেন:

এটিএম বুথ (ATM): সারা দেশের এটিএম বুথগুলো থেকে কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন স্বাভাবিক থাকবে।

মোবাইল ব্যাংকিং (MFS): বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলো সচল থাকবে।

অনলাইন ব্যাংকিং (Internet Banking): ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে ফান্ড ট্রান্সফার ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা যাবে।

আরও পড়ুন:

ব্যাংক হলিডে এর দিনে পরামর্শ ও পরবর্তী সূচি (Advisory & Schedule)

বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের বড় অংকের নগদ অর্থের প্রয়োজন বা জরুরি ব্যাংকিং কাজ রয়েছে, তাদের আজ ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই তা সেরে নেওয়া উচিত। তবে গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ আগামী ১ জানুয়ারি ২০২৬ (বৃহস্পতিবার) থেকে যথানিয়মে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বছরের লেনদেন শুরু করবে।

জরুরি লেনদেনে নেই বাধা: বড় অংকের টাকা ট্রান্সফার করবেন কীভাবে? জেনে নিন স্মার্ট সমাধান।

১. ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা মোবাইল অ্যাপ (Internet Banking/App)

বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংক তাদের নিজস্ব মোবাইল অ্যাপের (যেমন:BRAC Bank Astha, City Touch, EBL Skybank, Cellfin) মাধ্যমে বড় অংকের টাকা ট্রান্সফার করার সুবিধা দেয়।

ইন্টারনাল ট্রান্সফার: যদি প্রেরক ও প্রাপক একই ব্যাংকের গ্রাহক হন, তবে ব্যাংক হলিডেতে কোনো বাধা ছাড়াই তাৎক্ষণিক (Instant) কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পাঠানো সম্ভব।

NPSB (Instant Transfer): ভিন্ন ব্যাংকে টাকা পাঠানোর জন্য NPSB নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলে ব্যাংক ভেদে দিনে সাধারণত ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সাথে সাথে পাঠানো যায়। এটি ব্যাংক হলিডের দিনেও সচল থাকে।

আরও পড়ুন:

২. আরটিজিএস (RTGS) – ব্যাংক হলিডেতে সীমাবদ্ধতা:

সাধারণ সময়ে ১ লাখ টাকার বেশি পাঠাতে RTGS সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে মনে রাখবেন, ব্যাংক হলিডের দিন ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় সেটেলমেন্ট সিস্টেম বন্ধ থাকতে পারে। তাই ব্যাংক হলিডের দিন আরটিজিএস করলে সেই টাকা সাধারণত পরবর্তী কার্যদিবসে জমা হয়। জরুরি হলে অ্যাপের মাধ্যমে করার চেষ্টা করুন।

৩. এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিং (MFS - Bkash, Nagad, Rocket)

জরুরি প্রয়োজনে এটি একটি দ্রুত সমাধান।

লিমিট: বর্তমানে বিকাশ বা নগদে দিনে সর্বোচ্চ ২৫,০০০ টাকা পাঠানো যায়। তবে আপনি যদি একাধিক অ্যাকাউন্ট (যেমন নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের) ব্যবহার করেন, তবে একত্রে ১-২ লাখ টাকা পাঠানো সম্ভব।

ব্যাংক টু কার্ড/এমএফএস: আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরাসরি বিকাশ বা নগদে নিয়ে সেখান থেকেও পেমেন্ট বা ট্রান্সফার করতে পারেন।

আরও পড়ুন:

৪. ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার (Credit Card Payment)

যদি কোনো বড় কেনাকাটা বা বিল পেমেন্ট করার প্রয়োজন হয়, তবে ব্যাংক ট্রান্সফারের বদলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। এটি সরাসরি ব্যাংক ব্যালেন্সের ওপর নির্ভর করে না এবং ব্যাংক হলিডেতে এর ট্রানজেকশন প্রসেসিং সচল থাকে।

৫. এটিএম থেকে ক্যাশ উত্তোলন (ATM Withdrawal)

যদি নগদ টাকার প্রয়োজন হয়, তবে এটিএম বুথ সবচেয়ে বড় ভরসা।

লিমিট: অধিকাংশ ব্যাংকের কার্ডে প্রতিদিন ৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত উত্তোলনের সুবিধা থাকে। যদি আপনার বড় অংকের প্রয়োজন হয়, তবে ভিন্ন ভিন্ন কার্ড বা প্রি-পেইড কার্ড ব্যবহার করতে পারেন।

৬. কর্পোরেট ইন্টারনেট ব্যাংকিং (Corporate Internet Banking)

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংকগুলো বিশেষ পোর্টাল দিয়ে থাকে। ব্যাংক হলিডেতে লেনদেন সরাসরি কার্যকর না হলেও অনেক ক্ষেত্রে শিডিউল ট্রানজেকশন বা প্রি-অ্যাপ্রুভড ট্রানজেকশন প্রসেস করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন:

ব্যাংক হলিডে: অনলাইন লেনদেনের ১০টি নিরাপত্তা টিপস

১. সঠিক লিংকে প্রবেশ করুন (Check URL): অনলাইনে নেট ব্যাংকিং ব্যবহারের সময় নিশ্চিত হোন যে আপনি ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আছেন। ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে 'https://' এবং একটি প্যাডলক (🔒) চিহ্ন আছে কি না তা যাচাই করে নিন।

২. পাবলিক ওয়াই-ফাই এড়িয়ে চলুন (Avoid Public Wi-Fi): রাস্তাঘাট, শপিং মল বা ক্যাফেতে থাকা উন্মুক্ত ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে ব্যাংকিং লেনদেন করবেন না। এতে আপনার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড হ্যাক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। নিজস্ব মোবাইল ডাটা বা নিরাপদ হোম ওয়াই-ফাই ব্যবহার করুন।

৩. ওটিপি (OTP) শেয়ার করবেন না: ব্যাংক হলিডে বা যে কোনো সময় আপনার মোবাইলে আসা ওটিপি বা পিন নম্বর কাউকে বলবেন না। মনে রাখবেন, কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা কখনোই আপনার কাছে ফোনে ওটিপি বা পাসওয়ার্ড চাইবেন না।

৪. অ্যাপ আপডেট রাখুন (Update Banking Apps): লেনদেনের আগে আপনার ব্যাংকিং অ্যাপটি (যেমন: City Touch, EBL Skybank) সর্বশেষ ভার্সনে আপডেট করা আছে কি না দেখে নিন। আপডেট ভার্সনে সিকিউরিটি প্যাচগুলো বেশি উন্নত থাকে।

আরও পড়ুন:

৫. ফিশিং ইমেইল বা মেসেজ থেকে সাবধান: "আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে" বা "টাকা জিতছেন"—এমন প্রলোভন বা ভীতি দেখিয়ে কোনো ইমেইল বা লিংকে ক্লিক করতে বলা হলে তা এড়িয়ে চলুন। ব্যাংক হলিডের দিনে হ্যাকাররা এ ধরনের ভুয়া মেসেজ বেশি ছড়ায়।

৬. লেনদেন শেষে লগ-আউট করুন: কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে অ্যাপ বা ওয়েবসাইট থেকে অবশ্যই 'Log Out' করুন। ব্রাউজারে কখনোই পাসওয়ার্ড সেভ করে রাখবেন না।

৭. টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন (2FA): আপনার অ্যাকাউন্টে যদি টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু না থাকে, তবে আজই তা সক্রিয় করুন। এতে পাসওয়ার্ড চুরি হলেও আপনার অনুমতি ছাড়া কেউ টাকা সরাতে পারবে না।

৮. এটিএম বুথ ব্যবহারে সতর্কতা: ব্যাংক হলিডেতে টাকা তুলতে গিয়ে যদি দেখেন বুথের ভেতরে কেউ সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছে, তবে সেখান থেকে টাকা তোলা এড়িয়ে চলুন। কার্ড ঢোকানোর স্থানে কোনো এক্সট্রা ডিভাইস বা ক্যামেরা লাগানো আছে কি না দেখে নিন।

৯. ব্যালেন্স ও মেসেজ চেক করুন: প্রতিটি লেনদেনের পর ব্যাংকের কনফার্মেশন মেসেজটি ভালো করে পড়ুন। যদি আপনার অগোচরে কোনো লেনদেনের মেসেজ আসে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংকের ২৪/৭ কল সেন্টারে যোগাযোগ করুন।

১০. বড় লেনদেনে সতর্কতা: ব্যাংক হলিডের দিন আন্তঃব্যাংক বড় অংকের ফান্ড ট্রান্সফার (যেমন: BEFTN বা RTGS) সচল নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ভুল অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠালে তা ফেরত আনতে দেরি হতে পারে। তাই অ্যাকাউন্ট নম্বর ও নাম বারবার মিলিয়ে নিন।

আরও পড়ুন:


এসআর