বঞ্চিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার: প্রধান উপদেষ্টা

গঠিত কমিটির প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে
গঠিত কমিটির প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে | ছবি: এখন টিভি
1

সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত সদস্যের ন‍্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। আজ (রোববার, ৩০ নভেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিগত সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে ০৪ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চাকরিতে বৈষম্য, বঞ্চনা, অবিচার ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়া অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত অফিসারদের আবেদন পর্যালোচনাপূর্বক যথাবিহিত সুপারিশ পেশের জন্য গঠিত কমিটি প্রধান উপদেষ্টার নিকট প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর এ মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর যেসব সদস্যরা অন্যায়ভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ন্যায় বঞ্চিত এই সকল সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার।’

এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যখন আপনাদেরকে এই কাজটি করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল সামান্য কিছু অনিয়ম হয়ত হয়েছে, কিন্তু আপনারা যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে এনেছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। এটা কল্পনার একেবারে বাইরে।’

কমিটি সর্বমোট ৭৩৩টি অভিযোগ পায় যার মধ্যে ৪০৫টি গৃহীত হয়। কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত আবেদনের সংখ্যা ১১৪। কমিটির কার্যপরিধির আওতা বহির্ভূত আবেদন ২৪টি এবং ৯৯টির আবেদনকারীর ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গের, সাজা মওকুফের ও নৈতিক স্খলনজনিত বিষয় রয়েছে।

কমিটির সভাপতি আব্দুল হাফিজ জানান, আবেদনপত্র পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটি গত ১৯ আগস্ট ২০২৫ তারিখে প্রথম সভা আহ্বান করে। বঞ্চিত অফিসারদেরকে সেন্ট্রাল অফিসার্স রেকর্ড অফিস, আইএসপিআর এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখের মধ্যে আবেদন জমা দিতে বলা হয়।

জেনারেল আব্দুল হাফিজ জানান, স্ব স্ব বাহিনী কর্তৃক গঠিত বোর্ড যাদের বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করেছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো নৈতিক স্খলনজনিত শাস্তি কিংবা অভিযোগ ডোসিয়ারে লিপিবদ্ধ ছিল না। এই কমিটি স্ব স্ব বাহিনী কর্তৃক গঠিত বোর্ডের সুপারিশ আমলে নিয়ে সেগুলোর বাইরেও কমিটি বিবেচনা উপযুক্ত আবেদনসমূহে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং আবেদনকারীর সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সুপারিশ প্রদান করেছে।

অনেক আবেদনকারী সম্পর্কে কমিটির সদস্যবৃন্দ মতামত দিয়েছেন, আবেদনের যথার্থতা ও বঞ্চিত হওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাদের মতামত নির্মোহভাবে কমিটিতে উপস্থাপন করেছেন বলে জানান জেনারেল হাফিজ। তিনি বলেন, কমিটি ভুক্তভোগী অফিসারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অধিনায়ক ও ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বঞ্চনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।

কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদনকারীদের মধ্যে ছয় জন অফিসারকে তাদের আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দরুন বা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অপবাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিভিন্ন মেয়াদে (১ বছর হতে ৮ বছর পর্যন্ত) গুম করে রাখা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজির বিহীন। এমনকি একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, পরবর্তীতে উক্ত অফিসারের স্ত্রীকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক বছরের শিশুসহ বিনা বিচারে দুই দফায় দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে রাখা হয়।

তদন্তে আরও জানা যায়, কিছু সংখ্যক অফিসার ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বিডিআর হত্যাযজ্ঞের নারকীয় ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে পাঁচ জনকে একটি ভুয়া ঘটনা সাজিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করে।

আরও পড়ুন:

তদন্তে জানা যায়, পাঁচ জন অফিসার ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআইতে কর্মরত থাকাকালীন তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে কিংবা বিনা অভিযোগে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, কিছু অফিসার বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে প্রশ্ন করার জন্য সেনাসদর কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এক পর্যায়ে উক্ত দরবারে ব্যাপক হৈচৈ ও হট্টগোল হওয়ায়, পাঁচ জন অফিসারকে অযথা দায়ী করা হয় এবং তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

চারজন কনিষ্ঠ অফিসার (লেফটেন্যান্ট পদবির) ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ম-নিষ্ঠার সাথে পালন করার কারণে তাদেরকে কোনো একটি দলের অনুসারী হিসেবে অথবা জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে অন্যায়ভাবে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয় বলেও বেরিয়ে আসে তদন্তে।

তদন্ত দেখা যায়, ২৮ জন বিদ্যমান নীতিমালা অনুসরণ করে পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও গুম, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন ও জেরা, লোক দেখানো প্রহসনের তদন্ত ও বিচারহীন, আইন-বহির্ভূত কার্যকলাপে এই সব কর্মকর্তাগণ নানাবিধ বঞ্চনা, নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বর্ণনাতীত পারিবারিক ও সামাজিক লাঞ্ছনা এবং প্রভৃতি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীতে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার ১১৪ জন কর্মকর্তা সম্পর্কে সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। তাদেরকে (যার জন্য যা প্রযোজ্য) স্বাভাবিক অবসর প্রদান, পদোন্নতি, অবসর পূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করার জন্য কমিটি সুপারিশ করে। এর মধ্যে চারজনকে চাকুরিতে পুনঃবহাল করার জন্য কমিটি সুপারিশ করে।

নৌবাহিনীতে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার ১৯ জন কর্মকর্তাকে স্বাভাবিক অবসর প্রদান, পদোন্নতি, অবসরপূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করার জন্য কমিটি সুপারিশ করে। বিমান বাহিনীতে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার ১২ জন কর্মকর্তাকে স্বাভাবিক অবসর প্রদান, পদোন্নতি, অবসর পূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি প্রদান করার জন্য কমিটি সুপারিশ করে।

আবেদনকারীদের মধ্যে ১২৫ জন সেনা, ৫১ জন নৌ এবং ২৫ জন বিমানবাহিনীর সদস্য। বৈঠকে অন‍্যান‍্যদের মধ‍্যে মো. আশরাফ উদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ তারিক উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিটির সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ, কমিটির সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মুহম্মদ শামস-উল-হুদা, মেজর জেনারেল (অব.) শেখ পাশা হাবিব উদ্দিন, রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ শফিউল আজম এবং এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মুহাম্মদ শাফকাত আলী।

ইএ