স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পায়নি জনগণ, অর্জিত হয়নি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সংবিধানের দেয়া ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছে শাসকগোষ্ঠী। আওয়ামী শাসনামলের গত ১৬ বছরে চেপে বসা স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাতে করতে হয়েছে গণঅভ্যুত্থান। প্রাণ দিয়েছেন হাজারো মানুষ। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়েছে জনমনে।
তাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে ১১টি সংস্কার কমিশন। গুরুত্বপূর্ণ ৬টি সংস্কার কমিশন, সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন, মোট ১৬৬টি সংস্কার সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায়। প্রথম ধাপে ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে পৃথকভাবে ৪৪টি বৈঠক হয়। দ্বিতীয় ধাপে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। ৩১ জুলাই আলোচনা শেষ হয়। দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর ৮৪টি বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়।
জুলাই সনদের ১৭টি বিষয়ে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোট পুরোপুরি একমত। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার, অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, সুপ্রিম কোর্ট- বিভাগীয় পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে একমত বিএনপি, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দল। এসব সংস্কারকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যরিস্টার ইমরান সিদ্দীকি বলেন, ‘রাষ্ট্র, সরকার, রুলিং পার্টি, প্রধানমন্ত্রী— সব ছিল একটা ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। আপনি যখন ওই ব্যক্তির পদত্যাগ চাচ্ছেন তখন আপনি পুরো রাষ্ট্রের সংস্কার চাচ্ছেন। আপনি তখন সংবিধান সংস্কার চাচ্ছেন। জুলাই সনদের মধ্যে এ স্পিরিটটা ক্যাপচার করে। এটাকে একটা লিগ্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট বলা যাবে না হয়তো। কিন্তু এটাকে বলা যাবে একটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কন্সটিটিউশন ডকুমেন্ট।’
বাকি ৬৭টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে কিংবা দিয়েছে নোট অব ডিসেন্ট। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, দলীয় প্রধানের পদে প্রধানমন্ত্রীর না থাকা, সাংবিধানিক ৪ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান, নারীদের ৭ শতাংশ সরাসরি মনোনয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতের ভিন্নমত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভিন্নমত রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘জুলাইয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা এতগুলো নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে যে সনদ, তারা সাইন করতে পারে। কিন্তু এটা প্রতিফলিত হবে না। দ্বিতীয়ত এটা নির্বাচনের ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো যদি মতৈক্যে না আসে, তারা এখন মৌখিকভাবে একজন আরেকজনকে গালাগালি করছে, তারপর তারা তখন রাস্তায় নামবে।’
জুলাই সদন বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্য আছে। গণভোটে পাশ হবার পরও, যেসব সিদ্ধান্তে দলগুলোর আপত্তি রয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। তবে জামায়াত ও এনসিপির দাবি, জনগণ গণভোটে সনদের পক্ষে রায় দিলে 'নোট অব ডিসেন্ট' এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। এজন্য সাংবিধানিক আদেশ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার সাংবিধানিক আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাখেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন:
ব্যরিস্টার ইমরান সিদ্দীকি বলেন, ‘সংবিধান দেশ একটা দেয়া উচিত। কারণ সংবিধানের মৌলিক কিছু সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেটা আসলে অধ্যাদেশ দিয়ে করাটা ঠিক হবে না। নির্বাচন পরবর্তী সময় জনপ্রতিনিধিরা যে শুধু সংসদেরই বসবে না, তারা একটি কন্সটিটিউশন রিফর্ম অ্যাসেম্বলি হিসেবে বসবে, সে বিষয়টা কিন্তু এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।’
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ড. ইউনূস হলে চিফ এক্সিকিউটিভ, উনার পেছনে বাংলাদেশের আপামর জনতা আছে। উনি যদি একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতেন— যেহেতু তোমরা ঐকমত্যে আসোনি, আমি একটা ফাইনাল শেপ দিয়ে দেবো। তারপর উনি ওটা গণভোটে দিয়ে দিতে পারেন।’
জুলাই সনদের সাত দফা অঙ্গীকারনামায়, সনদকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে এর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তাই, আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদে সই করবে না জাতীয় নাগরিক পার্টি। জামায়াতও সাক্ষরের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছে বিএনপি।
যদিও গতকাল (বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর) কমিশনের সহসভাপতি বলেছেন, আগামী ১৪ দিনের মধ্যেই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কি হবে তা সুনির্দিষ্ট করবে সরকার। যেসব দল আজ জুলাই সনদে সই করবে না, তারা পরেও সই করতে পারবে। এমন প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক দলিল কতোটা জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।




