১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সুবাদার ইসলাম খান চিশতি বাংলার রাজদানী ঢাকায় স্থানান্তর করে। তখন শহরের ঠিক উত্তরপ্রন্ত ঘীরে মীর জুমলা গেট স্থাপন করা হয় ঢাকাকে বর্হিশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে। তবে বর্তমানে এটি শহরের ঠিক প্রাণকেন্দ্রে। এ থেকেই বোঘা যায় ঢাকার বিস্তৃতি বেড়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। ঢাকার আয়তন এবং জনসংখ্যা নিয়ে কীভাবে শহর ঢাকা মেগাসিটিতে রূপান্তর হলো?
তবে সম্প্রতি পুরান ঢাকায় এক খননকার্যে ১৪৩০ সালের প্রাসাদ বা দুর্গের নিদর্শন মিলেছে। চমকপ্রদ এমন স্থাপনা দেখে প্রত্মতাত্ত্বিক ও গবেষকরা ধারণা করছেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকে ঢাকা অঞ্চলে জনপদ ছিল। সে হিসাবে ঢাকার বয়স আড়াই হাজার বছরের বেশি।
আমরা বরং রাজধানী ঢাকার পত্তন পরবর্তী সময়ে হাঁটি।
মোঘল আমলে ঢাকার মূল নগরীর বিস্তৃতি ছিল বুড়িগঙ্গা বরাবর সাত থেকে দশ মাইল এবং অভ্যন্তরভাগে আড়াই মাইল পর্যন্ত। নদীকেন্দ্রীক নগরের প্রমাণ মেলে ছোট কাটারা, বড় কাটারা, লালবাগ দুর্গের মতো স্থাপনায়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে রাজধানীর মর্যাদা না থাকলেও জাদুর শহর ঢাকা সমৃদ্ধি লাভ করে বাণিজ্যিকভাবে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। মানুষের বসবাস বেড়ে যায় এই অঞ্চলে। ১৯১০ সালে ঢাকায় বসবাস করতেন এক লাখ ৫৯ হাজার মানুষ। ১৯৫১ সালে দুই লাখ ৭১ হাজারের মতো। আর ১৯৭০ সালের ঢাকার জনসংখ্যা নয়গুণ বেড়ে পৌঁছায় প্রায় ১৮ লাখে।
মানুষের বসবাসের সাথে পাল্লা দিয়ে স্বভাবতই রাজধানী ঢাকার আয়তনও বৃদ্ধির পায়। স্বাধীনতার আগে ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজধানীর আয়তন ছিল মাত্র ৭২.৫২ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০.৬৫ বর্গকিলোমিটারে। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ঢাকার সীমানা দাঁড়ায় ১০৩.৬ বর্গকিলোমিটারে। বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউকের অধিভুক্ত ঢাকার আয়তন এক হাজার ৬৮৩ দশমিক পাঁচ বর্গকিলোমিটার।
১৯৯০ সালে এসে ঢাকা পৌর করপোরেশন রূপান্তরিত হয় 'ঢাকা সিটি করপোরেশনে'। ২০১১ ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ দুইভাগে ভাগ করা হয়। যেখানে যুক্ত করা হয়েছে শহরতলীর আরও এলাকা। এতে ঢাকার গণ্ডি বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ছুঁয়েছে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত। আবাসন প্রকল্প তৈরি হচ্ছে গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, উত্তরা এবং কেরানীগঞ্জের মতো প্রান্তিক এলাকায়। সেখানে বসবাসরতদের কাছে জানতে চাই, শহরের কেন্দ্র থেকে এত দূরে বসবাস কেন?
রূপগঞ্জে বসবাসকারীদের মধ্যে একজন বলেন, 'রেগুলার অফিস আসতেছি, যাচ্ছি, এখান থেকেই সবাই অফিস করে। আগের মতো নেই, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো।'
এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডের মানুষ নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন। হোল্ডিং ট্যাক্স, পানি-বিদ্যুতের অর্থ পরিশোধ করেও পাচ্ছেন না কোনো নাগরিক সেবা।
স্থানীয় একজন বলেন, 'কোনো তদারকি নাই, কোনো সেবা নাই। যে যে আসছে সে তার মতো থাকে। কোনো দিন আসে না, কোনো খোঁজ-খবর নেয় না।'
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সরকারের দুর্বলতা এবং ব্যর্থতায় নাগরিকদের ঢাকা কেন্দ্রীকতা বাড়ছে। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে পড়তে যাচ্ছে পুরো শহর।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'ঢাকার বিকাশটা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত, পরিবেশকে একদমই অগ্রাহ্য করে করা। যার ফলে এখানে যতই মেট্রোরেল করেন ঢাকা বাঁচবে না, দেশ বাঁচবে না। দেশ ডুবানোর জন্য মূলত অতিমাত্রিক ঢাকা কেন্দ্রিকতা, টি আমাদের দেশকে সাংঘাতিকভাবে ডুবিয়েছে, সামনে আরও ডুবাবে।'
এদিকে সম্প্রতি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় ঢাকার বিকল্প রাজধানী গড়ার সুপারিশ করা হয়েছে। স্থানান্তরের সাথে একমত রাজউকও। সেই অনুযায়ী মহাপরিকল্পনার কথাও জানায় রাজউকের প্রধান নগরবিদ আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, 'মূল সেন্ট্রাল ঢাকার ঢাকার চারপাশে কীভাবে পরিকল্পিত নগরায়ন করা যায়, সেখানে যেমন ছয়টা মেট্রোরেলের বিস্তৃতি আমরা তৈরি করতেছি। যেটা ঢাকার আশেপাশে পর্যন্ত করিডোরকে কানেক্ট করবে। তাহলে ঢাকামূখী স্রোতকে বিভিন্নদিকে সেন্ট্রালাইজ করে দেয়া যাবে।'
মানুষের অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া সামাজিক কারণেও ঢাকার জনসংখ্যা ও আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিমত পপুলেশন সায়েন্সেসের অধ্যাপকের। রাজধানী স্থানান্তরের প্রশ্নে অন্য দেশের মতো প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক রাজধানী গঠনের প্রস্তাবনা দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, 'ঢাকার বাইরে বিকল্প রাজধানী যে চিন্তা করা, সেটি কিন্তু আমরা এখনও চিন্তা করছি না। পুনঃগত জীবন তাদের হবে কী না, সেগুলো যদি নিশ্চিত না করতে পারি, তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি, অন্যান্য যে সেবাগুলো রয়েছে সেগুলো যদি না করতে পারি তাহলে বিশ্বমানদণ্ডে আমরা পিছিয়ে থাকবো।'
দেশের মোট আয়তনের এক শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত ঢাকা মহানগরে মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ বাসবাস করেন। এরমধ্যে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থায়ীভাবে ঢাকামুখী হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং ঢাকাকে বাঁচাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকরী সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান সবার।