'এলাহি কাণ্ড' ঠিক কাকে বলে? বুঝিয়ে দিচ্ছেন ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি। অবশ্য আম্বানি পরিবারের বিয়ের উৎসব আয়োজনের সামনে বাংলা এ প্রবাদও যেন ম্লান।
সব ঠিক থাকলে ভারতের আরেক শিল্পপতি বীরেন মার্চেন্টের মেয়ে রাধিকা মার্চেন্টের সঙ্গে আগামী ১২ জুলাই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছেন মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি। বিয়ের আগেই দুই-দুইটি গ্র্যান্ড প্রি-ওয়েডিংসহ বছরজুড়ে নানা ধামাকাদার আয়োজন করে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন হবু দম্পতি।
গেলো মার্চ মাসে ভারতে গুজরাটের জামনগরে অনন্ত-রাধিকার বিয়ে পূর্ববর্তী আয়োজনে অতিথি ছিলেন দেশ-বিদেশের ১২শ' খ্যাতনামা ব্যবসায়ী নেতা, রাজনীতিবিদ, খেলাধুলা ও বিনোদন অঙ্গনের অনেকে।
এদের মধ্যে ছিলেন সারা বিশ্বের অর্থনীতি হাতের মুঠোয় রাখা ব্যবসায়ী অনেক নেতা- মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ, অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই, টেড ডিকের প্রধান নির্বাহী মর্গ্যান স্ট্যানলি, ডিজনির প্রধান নির্বাহী বব আইগার, ব্ল্যাকরকের প্রধান নির্বাহী ল্যারি ফিংক, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প আর তার স্বামী জ্যারেড কুশনার।
পপতারকা রিহানা, বলিউড তারকা শাহরুখ-সালমান-আমির খানসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিনোদন শিল্পীরা মাতিয়ে তোলেন অতিথিদের। এক ছাদের নিচে পৃথিবীর তামাম বিত্তশালীদের এই উপস্থিতি সারা বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে সে সময়।
তিনদিনের চোখ ধাঁধাঁনো ওই আয়োজনের রেশ কাটতে না কাটতেই মে মাসের শেষে দ্বিতীয় প্রি-ওয়েডিংয়ের আয়োজন আবারও চমকে দেয় বিশ্বকে। এবার ইতালি থেকে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে চারদিনব্যাপী আয়োজনে যোগ দেন ৮শ' অতিথি।
অতিথিদের যাত্রায় স্বস্তি নিশ্চিতে প্রমোদতরীতে আরও ছিলেন ৬শ' কর্মী। খানদের পাশাপাশি আম্বানি পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলিউড তারকারা ডাক পেয়েছিলেন সাগরের বুকে এ আয়োজনেও। প্রমোদতরীর একেকটি স্যুটের খরচ প্রতি রাত ৬০ লাখ রুপি করে, সঙ্গে ছিল অতিথিদের জন্য স্পা, সুইমিং পুল, জিমসহ আরও অনেক সুবিধা।
প্রথম প্রি-ওয়েডিং আয়োজনে ভারতীয় মুদ্রায় ১২শ' ৫৯ কোটি রুপি এবং দ্বিতীয় প্রি-ওয়েডিংয়ে সাড়ে সাত হাজার কোটি রুপি খরচ করে আম্বানি পরিবার। বিয়ের বাদেই এমন বিপুল খরচ করে অপচয়, অসংযত আচরণ, দম্ভ, সম্পদ জাহির করাসহ সমালোচনাও কম হয়নি আম্বানিদের নিয়ে।
বলা বাহুল্য, ব্যবসায়ী পরিবারটির বিয়ে সংক্রান্ত সব উৎসব আয়োজনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আর্থ-রাজনীতিরও, যা বুঝতে হলে জেনে নিতে হবে কিছু পরিসংখ্যান।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল, প্রায় দেড়শ' কোটি মানুষের দেশ ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি সমগ্র এশিয়া মহাদেশেও শীর্ষ সম্পদশালী ব্যক্তি। ফোর্বসের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় বিশ্বে মুকেশের অবস্থান ১১তম, সম্পদের পরিমাণ ১২ হাজার ২শ' কোটি ডলার।
উল্টোদিকে, ভারতের সরকারি থিংক ট্যাংক এনআইটিআই'র সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ১১ শতাংশের বেশি। প্রকৃত হার আরও বেশি বলে বিতর্ক তো আছেই।
গেলো বছর অক্টোবরে প্রকাশিত বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বিশ্বের ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১১১তম, বাংলাদেশের ৮১তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ২২ গুণ, জনসংখ্যায় আট গুণ ও অর্থনীতিতে তিনগুণ বড় ভারত ক্ষুধার প্রশ্নে প্রতিবেশির চেয়ে পিছিয়ে ৩০ ধাপ।
দেশের এমন কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশের ছোট ছেলের বিয়ের আগেই এমন জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চোখে লেগেছে বহু মানুষের। বিয়ে পর্যন্ত পুরো আয়োজনে কতো পয়সা ঢালছেন আম্বানি, সেটাও গুণতে বসে গেছেন অনেকে।
বিয়ের নিমন্ত্রণেও পত্র দেয়নি আম্বানি পরিবার। স্বর্ণে তৈরি দেবমূর্তি, রূপার মন্দির, গনেশ-বিষ্ণু-লক্ষ্মী-রাধাকৃষ্ণ-দুর্গাসহ বিভিন্ন দেবদেবীর স্বর্ণখচিত ছবিসহ হরেকরকম ব্যয়বহুল উপহারসমেত সিন্দুকসদৃশ বাক্স পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ জানানোতেও পরিবারের নাম রেখেছে আম্বানিরা।
ছেলের বিয়ে সামনে রেখে সমাজকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে গেলো সপ্তাহেই গণবিবাহের আয়োজনেও পৃষ্ঠপোষকতা করে আম্বানি পরিবার। এর আগে বাকি দুই ছেলেমেয়ের বিয়েতেও এলাহি আয়োজন থাকলেও সবকিছুকে হার মানিয়েছে ছোট ছেলে অনন্তর বিয়ে।
কিন্তু এতো খরচেও সম্পদ কমছে না ৬৭ বছর বয়সী মুকেশ আম্বানির। জনমনে বিস্ময়- কোন পরশপাথরের সন্ধান পেয়েছেন এই শিল্পপতি? অনন্ত-রাধিকার বিয়ের আগেও পুঁজিবাজারে লাফিয়ে বাড়ছে বাজারমূল্যে ভারতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সের শেয়ারদর।
২৬ জুন পর্যন্ত শুধু পুঁজিবাজার থেকে ভাণ্ডারে আরও ৮০ হাজার কোটি রুপির বেশি সম্পদ বেড়েছে রিলায়েন্স প্রধানের। বলা হচ্ছে, বিশ্বের সম্ভাব্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ের আয়োজনে শুধু খরচ বাড়েনি, বরং আর্থ-রাজনৈতিক অর্জন বাড়াতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রও এই মহা আয়োজন।
বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা আর প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ প্রি-ওয়েডিং আয়োজনের অর্থনৈতিক তাৎপর্য কম নয়। এক ছাদের নিচে সবার হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতিতে খুলেছে নতুন ব্যবসা, বিনিয়োগ আর উদ্যোগ গ্রহণের দুয়ার। এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়বে আম্বানি রাজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা।
নিঃসন্দেহেই এই গ্র্যান্ড ইভেন্ট বিশ্ব অর্থনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে আম্বানি ও রিলায়েন্সের। শুধু ভারতে নয়, গোটা দুনিয়ায় গতি পেয়েছে রিল্যায়েন্সের ব্র্যান্ডিং আর বিপণন। কারণ এ ধরনের আয়োজনের ফলে যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, ব্যবসার জগতে তা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। 'সোশ্যাল ক্যাপিটাল' হিসেবে পরিচিত এসব আয়োজন ভবিষ্যতের জন্য আম্বানি পোর্টফোলিও তৈরির পুঁজি হিসেবে কাজ করবে।
এ ধরনের মহা আয়োজনের আছে রাজনৈতিক গুরুত্বও। ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ আম্বানিরা। ২০১৯ সালের এপ্রিলে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে মোদির এক নির্বাচনী জনসভায় একদম সামনের আসনে উপস্থিত ছিলেন অনন্ত আম্বানি।
আম্বানিদের পারিবারিক বসতি গুজরাটে। মোদিও জন্মসূত্রে গুজরাটের বাসিন্দা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এক যুগের বেশি সময় ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে। কয়েক মাস আগেই ভারতের সম্পদশালীদের বিয়ের অনুষ্ঠান বিদেশে আয়োজন না করে দেশের অর্থ দেশে রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন মোদি।
এরপরই প্রথম প্রি ওয়েডিং আয়োজনের জন্য গুজরাটের জামনগরকে বেছে নেন অনন্ত আম্বানি। আগামী সপ্তাহে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতাও সারবেন মুম্বাইয়ের জিও ওয়ার্ল্ড সেন্টারে। মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের ভেতরে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজনের মাধ্যমে শুধু সরকারের উদ্দেশ্য সফলেই কাজ করেনি আম্বানি পরিবার, একইসঙ্গে ক্ষমতা বৃদ্ধির পথও সুগম করেছে।
সবমিলিয়ে জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণের চোখে পানিতে টাকা ঢালা বলে মনে হলেও আম্বানিদের বিশাল পারিবারিক ব্যবসার প্রেক্ষাপটে চোখ ধাঁধাঁনো এসব আয়োজন আদতে কৌশলগত বিনিয়োগ।