ইউক্রেনের দক্ষিণে খারসন অঞ্চলে কৌশলগত নিপ্রো নদীর উপকূলীয় অঞ্চল দখলে নিতে রুশ সেনাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত। সর্বশক্তি দিয়ে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া ইউক্রেনের সেনারা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর মার্চে খারসন দখল করে রাশিয়া। একই বছরের নভেম্বরে ইউক্রেনের সেনারা অঞ্চলটি স্বাধীন করলেও তখন থেকেই প্রায় প্রতিদিনই সেখানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনারা।
ইউক্রেনের একজন সেনাসদস্য বলেন, 'রুশ সেনারা যখনই নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছে, আমরা ঠেকিয়ে দিচ্ছি। এ পর্যন্ত তাদের প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।'
ইউক্রেনের অন্য একজন সেনাসদস্য বলেন, 'আমাদের প্রতিরক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে তারা অনেক নৌকা আর জনবল নিয়ে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছে। আরেকটি কৌশল হলো ঘন কুয়াশার সময় একসাথে কয়েকটি জায়গায় হামলা চালানো। তবে এখন পর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ।'
যুদ্ধ শুরুর তিন বছর পর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ইউক্রেন-রাশিয়ার অস্ত্রবিরতির সম্ভাবনা যেন একটু একটু করে আলোর মুখ দেখছে। কিন্তু সংঘাতকবলিত অঞ্চলগুলোতে সদাসতর্ক দু'পক্ষের সেনারা। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার ড্রোন হামলায় আবারও দুর্ঘটনার কবলে পরিত্যক্ত চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০০ সাল থেকে পুরোপুরি বাতিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম বিপজ্জনক পারমাণবিক উপাদান নিঃসরণ ঠেকানোর লক্ষ্যে নির্মিত বদ্ধ অবকাঠামোতে ড্রোন হামলার তথ্য শুক্রবার নিশ্চিত করে প্রশাসন। এ দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো শুরু হয়নি বলে আশ্বস্ত করেছে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা।
ইউক্রেনের চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী ওলেক্সান্দার তিতারশুক বলেন, 'বহির্ভাগ ফুটো করে ভেতরে গিয়ে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছে ড্রোনটি। অল্পের জন্য ৪০ বছরের পুরনো মূল অবকাঠামোতে আঘাত হানতে পারেনি। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা ঠেকানোর যতোটা সক্ষমতা ছিল বাইরের অবকাঠামোটির, সেটি এখন নেই। অদূর ভবিষ্যতে ঝুঁকি ন্যূনতম রাখতে যা করা সম্ভব, আমরা করছি।'
আইএইএ'র মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি বলেন, 'বিষয়টি খুবই গুরুতর। তবে আমরা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি যে এ হামলার ফলে কোনো ধরনের তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি হয়নি।'
এদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে নিরাপত্তা নীতিমালা নিয়ে আলোচনায় জার্মানিতে এ বছর বসেছে তিনদিনের মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের ৬১তম আসর। এবারের আয়োজনে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল রুশ দখলদারিত্বমুক্ত রেখেই ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খোঁজা এবং প্রতিরক্ষায় ইউরোপের বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু'টি বিষয়ই উপেক্ষিত হয় সম্মেলনে উপস্থিত শীর্ষ মার্কিন প্রতিনিধি বক্তব্য বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ায়। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ২০ মিনিটের পুরো বক্তব্যে ছিল যুক্তরাজ্যসহ দীর্ঘদিনের ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতি আক্রমণ। ভ্যান্সের ভাষণ যে ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল, ভাষণের সময় হলজুড়ে থমথমে নীরবতা প্রমাণ করেছে সেটাই। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে ইউরোপের দেশগুলোতে শিথিল অভিবাসন নীতি, মৌলিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে বাকস্বাধীনতায় ইউরোপ সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠছে বলে সমালোচনা করেন ভ্যান্স; যা তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেন, 'ইউরোপের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চীন কিংবা রাশিয়া নয়, বরং ইউরোপের ভেতরের পরিস্থিতিই আমাকে চিন্তিত করছে। ইউরোপ থেকে এ অঞ্চলের মৌলিক মূল্যবোধগুলোই নির্মূল হওয়ার পথে, যেসব মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক। যুক্তরাজ্যসহ পুরো ইউরোপে বাকস্বাধীনতা হারানোর মুখে বলে আতঙ্কিত আমরা।'
জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস বলেন, 'আমাদের গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের শোষণ বা দমনের যে অভিযোগ ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স তুলেছেন, তার তীব্র বিরোধিতা করছি। কাদের বিরুদ্ধে এবং কেন আমাদের আত্মরক্ষা, তা ভালোভাবেই জানি আমরা। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মর্যাদা রক্ষায় আমরা নিয়োজিত।'
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও ওভাল অফিসে বসে ভ্যান্সের বক্তব্যে সমর্থন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। অন্যদিকে, সম্মেলনের মূল আলোচ্য হিসেবে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে ইউক্রেন ইস্যু উপেক্ষিত থেকে গেলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে বৈঠক করেন ভ্যান্স। তিন বছরের জড়তা ভেঙে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের ৯০ মিনিটের ফোনালাপের খবরে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা হতবাক হলেও ভ্যান্সের সাথে ইতিবাচক সুরে কথা বলার চেষ্টা করেন জেলেনস্কি। মার্কিন প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোতে কিয়েভের যোগ দেয়ার স্বপ্ন ট্রাম্প প্রশাসন গুঁড়িয়ে দিলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সৈন্যসংখ্যা দ্বিগুণ করতে চান বলে জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।