চার বছরে গড়ালো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, নতুন মাত্রায় ভূ-রাজনীতি

ইউরোপ
বিদেশে এখন
0

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তিন বছর পেরিয়ে সংঘাত গড়ালো চতুর্থ বছরে। এই তিন বছরে বিশ্বের ভূ-রাজনীতি পৌঁছেছে নতুন মাত্রায়। কিয়েভের হিসেব মতে, প্রাণ গেছে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষের। আহত হয়েছেন প্রায় চার লাখ। এতকিছুর পরেও কবে যুদ্ধ শেষ হবে, মিলছে না সে উত্তর।

প্রাণহানি, যুদ্ধাহত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা সয়ে বেঁচে থাকা, স্বজন হারানোর শোক, যুদ্ধে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার তৃতীয় বছর। যুদ্ধ গড়ালো চতুর্থ বছরে। ভালো ভবিষ্যতের আশায় বিশ্বজুড়ে সংহতির রব উঠলেও সে সংহতি যেন মরীচিকা মাত্র।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান শুরু করে প্রতিবেশী রাশিয়া। তিন বছরে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ গেছে ইউক্রেনের ৪৬ হাজারের বেশি সেনার, তথ্য কিয়েভের। নিখোঁজ কিংবা শত্রুপক্ষের হেফাজতে আটক কয়েক লাখ।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের তথ্য, রুশ সেনাবাহিনীর ৯৫ হাজারের বেশি সেনা প্রাণ হারিয়েছে যুদ্ধে। জাতিসংঘের তথ্য, আড়াই হাজার শিশুসহ নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। ২০১৪ সালে রুশ সেনাবাহিনীর ক্রিমিয়া ও ডনবাস আত্মসাৎ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সবমিলিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণহানি মতান্তরে প্রায় ১০ লাখ।

রাশিয়ার বিরামহীন হামলায় ভেঙে পড়েছে ইউক্রেনের বিশাল অবকাঠামো। ক্ষতিগ্রস্ত বা বিধ্বস্ত ১০ শতাংশের বেশি আবাসিক স্থাপনা, আশ্রয়হীন ২০ লাখের বেশি মানুষ। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রার দেশে টানা তিনটি শীত বিদ্যুৎ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও জরুরি পরিষেবা ছাড়া পার করছে সোয়া এক কোটির বেশি মানুষ। সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলার ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

বেশিরভাগ হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার একেকটি দিনের খরচ ৫০ থেকে ১শ' কোটি ডলার। যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে রুশ হামলায় ইউক্রেনে প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ১৫ হাজার কোটি ডলার।

আসছে জুন পর্যন্ত তিন বছর চার মাসে ইউক্রেনের বাণিজ্য ও শিল্প খাতে ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ১৭ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে তথ্য জার্মান পরিসাংখ্যিক তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার। যুদ্ধ শেষে ইউক্রেন পুনর্গঠনে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি ডলার দরকার হবে বলে উঠে আসে সাম্প্রতিক রোম সম্মেলনে।

যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগ দিতে চাওয়া আর প্রতিবেশী রাশিয়ার আপত্তি পর্যায়ক্রমে রূপ নেয় সামরিক সংঘাতে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান এবং ক্রিমিয়া, ডনবাস, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খারসন ও ঝাপোরিঝিয়া দখলে নেয়ার আরেকটি বড় কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ। ডনবাসে লিথিয়ামের মজুত এবং ইউক্রেনের শস্যভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে বিশ্ববাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে রাশিয়া।

পশ্চিমা আধিপত্য বিরোধী শক্তির উত্থান রুখতেই, যুদ্ধের তিন বছরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অজস্র সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের, অর্থাৎ বিশ্ব রাজনীতিতে শীর্ষ প্রভাবশালীয় দেশগুলো। ইউক্রেনের জন্য অর্থের অঙ্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বরাদ্দকৃত সহায়তার পরিমাণ হাজার হাজার কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনকে এ পর্যায়ে সহায়তা দেয়া বন্ধ করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।

একইসাথে এযাবৎ দেয়া সহায়তার বিনিময়ে ইউক্রেনের রেয়ার আর্থ বা দুর্লভ খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারে প্রবেশাধিকারও চেয়েছেন তিনি। যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিলেও আলোচনার টেবিলে রাখেনি ইউক্রেন, এমনকি মার্কিনিদের চিরমিত্র ইউরোপের কোনো দেশকেও।

সবমিলিয়ে যুদ্ধের শেষ কবে, মিলছে না তার বিন্দুমাত্র আভাস। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি, কমেছে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। নতুন মাত্রা নিয়েছে ভূরাজনীতিও। ইউরোপ কি শক্তি হারাচ্ছে?

কিংবা মহাদেশটির পতন এবং ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার উত্থানের গতিবৃদ্ধি পাচ্ছে কি না ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে- এমন নানা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে; যার উত্তর মিলতে পারে কেবল এ যুদ্ধের পর্দা নামলেই।

এসএস