ইউক্রেন ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে ন্যাটো

ইউরোপ
বিদেশে এখন
0

রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে সম্মিলিতভাবে পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক সহায়তা দিয়ে গেলেও যুদ্ধবিরতির আলোচনা হয়েছে ইউরোপকে ছাড়াই। পেন্টাগন প্রধান সতর্ক করে বলেছেন, ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার দায়ভার যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়। বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, ইউক্রেনে শান্তি ইউরোপের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে ন্যাটো।

২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ইউক্রেনে যখন রাশিয়া সেনা অভিযান শুরু করে, সেই সময় থেকে জো বাইডেন দায়িত্বে থাকা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ একসঙ্গে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। অথচ ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনার পুরো কৃতিত্ব নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প একাই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এই বিষয়ে বোঝাপড়ার কোন প্রয়োজনই মনে করেননি তিনি।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, গণমাধ্যমে এমন খবর প্রচারের পর এই বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো। ব্রিটেন, ফ্রান্স আর জার্মানি বলছে, ইউরোপের ভূমিকা ছাড়া ইউক্রেনে কখনই শান্তি সম্ভব নয়। ইউক্রেনের ভাগ্য নির্ধারণে ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে বলেও জানায় ইউরোপের সাত দেশসহ ইউরোপীয়ান কমিশন। প্যারিসে পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে দেয়া হয় যৌথ বিবৃতি। বলা হয়, ন্যাটোর পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে দেয়া হবে সব ধরনের সহায়তা।

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলে বলেন, '২০২৪ সালে ইউক্রেনকে চার হাজার কোটি ইউরোর সামরিক সহায়তা দেয়ার চুক্তি করেছিল ন্যাটো। দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি ইউরোর সহায়তা। ইউরোপের দেশগুলোই ৬০ শতাংশ অস্ত্র দিয়েছে ইউক্রেনকে। ইউরোপের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই যুদ্ধ কোনো দেশের একার না। সীমান্ত পুনরায় আকার চেষ্টা করা হচ্ছে মানে সব দেশের জন্য হুমকি।'

ইউরোপকে বাইরে রেখে ট্রাম্প আর পুতিনের ফোনালাপে এই মহাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে ইইউ'র নেতারা পড়ে গেছেন শঙ্কায়। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্রকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলেও তিনি বলেন, ইউরোপের কোন দেশ এখনও আলোচনায় অংশ নেয়নি। তবে কি ইউক্রেন - রাশিয়া যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন? উঠছে সেই প্রশ্নও। কারণ ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে পেন্টাগন প্রধান বলেছেন, যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়া সম্ভব হবে না। পাশাপাশি ২০১৪ সালের পর হারানো এলাকাগুলোর দাবি কিয়েভকে ছাড়তে হবে।

পেন্টাগন প্রধান পিট হেগসেথ বলেন, 'মরীচিকার পেছনে দৌড়ালে যুদ্ধের সময়কাল বাড়তেই থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়া কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। ইউক্রেনে কোনো সেনা মোতায়েন থাকলে সেটাও ন্যাটোর বাইরে থাকতে হবে। ইউরোপের উচিত ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা অব্যাহত রাখা। আমরা এখন নিজেদের সীমান্ত রক্ষায় বেশি জোর দিতে চাই। ন্যাটোর সঙ্গে আছি। কিন্তু আমাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো যাবে না।'

কিন্তু যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও কিয়েভের বিরল খনিজের দাবি ছাড়ছে না ট্রাম্প প্রশাসন। অর্থসচিব জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির পর চুক্তি অনুযায়ী, দুর্বল খনিজের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিপরীতে ৫০ হাজার কোটি ডলারের রেয়ার আর্থ মিনারেল চেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধবিরতি হয়ে গেলে সামরিক সহায়তার প্রয়োজন পড়বে না ইউক্রেনের। এরপরও এই খনিজের দাবি ছাড়ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ত বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র আর ইউক্রেন বহুদিন ধরে অর্থনীতি, নিরাপত্তা নিয়ে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। রুশ নেতৃত্বের জন্য এটাই বড় বার্তা। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ইউক্রেনের নিরাপত্তায় ঢাল হয়ে থাকবো আমরা। সংঘাত শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী, বিরল খনিজগুলোর নিরাপত্তা দিতে কাজ করবো আমরা।'

ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দেয়া যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করে দেবে কিনা এমন আশঙ্কার মধ্যে ন্যাটো প্রধান সুর মিলিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একা নয়, ইউক্রেনকে সহায়তার দায় ইউরোপের সব দেশের। তবে মার্ক রুট বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে যতোটা শক্তিশালী হবে, ততোটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে আলোচনার টেবিলে।

ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট বলেন, 'আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক, ন্যাটো ভূখণ্ড রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি প্রতিরক্ষা খাতে মোট বাজেটের দুই শতাংশ ব্যয় করি, চার থেকে পাঁচ বছর পর নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রতিরক্ষা খাতে আমাদের আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।'

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রশাসন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হওয়ায় ট্রান্স আটলান্টিক অ্যালায়েন্স - ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাফায়েল লস বলেন, 'অনেকেই আশা করে আছে, ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে। ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তার বিষয়টি আশাহত করেছে। পিট হেগসেথের কথায় ভ্লাদিমির পুতিন সাহস পেলেন। ইউক্রেন দখলের চেষ্টা রাশিয়ার এখনও আছে। রামস্টেইনে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটিতে বৈঠক এটাই প্রমাণ করে, ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে।'

ক্ষমতায় এসেই ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, সামরিক খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে ন্যাটো থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এবার আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধেও ন্যাটোর হয়ে আর বিনিয়োগ করবে না ওয়াশিংটন। এতে করে শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো মহাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

এসএস